সুপ্রিম কোর্টের পর নিম্ন আদালতেও দৈনন্দিন মামলার ই-কার্যতালিকা তৈরি করা হয়েছে। ফলে প্রতিদিনের নিজ নিজ মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে স্পষ্টত ধারণা নিতে পারছেন বিচারপ্রার্থীরা। তবে অনলাইনে মামলার আদেশ দেখা গেলেও এখনও থেমে নেই বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি। বিশেষ করে দেশের সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলার আদেশের পর প্রায় ১২টিরও বেশি টেবিল ঘুরে তবেই কাঙ্ক্ষিত অনুলিপি হাতে পাচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। আবার দ্রুততার সঙ্গে আদেশের কপি পেতে বাড়তি খরচ হিসেবে ‘তদবির’ নামের ঘুষও গুনতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। বিচারপ্রার্থীদের এই দীর্ঘ হয়রানি ও আদালতের বিভিন্ন সেকশনের দুর্নীতি বন্ধে ই-ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালুর প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে উঠেছে। বিচার বিভাগের এমন আধুনিক সংস্কার করা হলে আদালতকেন্দ্রিক নাগরিকসেবা বাড়বে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহি আরও বেগবান হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচার বিভাগের সংস্কারের লক্ষ্যে পৃথক সচিবালয়, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনসহ বিচার বিভাগের দুর্নীতি রোধে ঘোষণা করেন বিশেষ কিছু রোডম্যাপ। যার আলোকে বিচার বিভাগের মানোন্নয়নে তিনি দেশের সব বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বিচার বিভাগকে অন্যূন উচ্চতায় নিয়ে যেতে কাজ করে যাচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে দেশের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি বাড়াতে ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি বিচারসেবা সহজ করাসহ পেশাগত কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার অফিসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর উদ্দেশে ১২ দফা নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। সেসব নির্দেশনায় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সব ধরনের আর্থিক লেনদেন বর্জন করা ছিল অন্যতম সতর্কবাণী।
বিচার বিভাগ সংস্কারের অংশ হিসেবে এখন অনলাইনের মাধ্যমে এক ক্লিকেই জামিননামা জেলখানায় পৌঁছে যাচ্ছে। এ বিষয়ে গত ১৪ অক্টোবর আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সুপ্রিম কোর্টে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘‘একজন লোকের জামিনের পর ছাড়া পাওয়া পর্যন্ত ১২টি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বলে আমি শুনেছি। কোনও ধাপে টাকা দিতে হয়, কোনও ধাপে হয়রানি হতে হয়। আমরা পাইলট প্রজেক্ট চালু করতে যাচ্ছি। একটা ক্লিক করবে, আদালতের রায় থেকে সরাসরি এটা (জামিননামা) জেলখানায় পৌঁছে যাবে, যে জেলখানায় আসামি আছেন।’’
তবে শুধু জামিননামা অনলাইনে পাঠালেই হবে না, আদালতের সেকশনগুলোতেও পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন বিচারপ্রার্থী আবুল বাশার পাটোয়ারী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘দেশের অনেক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ই-ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু রয়েছে। তা থেকে আমরা নাগরিকরা সুবিধা পাচ্ছি। আমার ভাইয়ের একটি জামিন সংক্রান্ত মামলার আদেশের কপি পেতে ১১ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রথমে বুঝিনি। পরে তদবির করতে হয়েছে। আমার আইনজীবীর ক্লার্ককে দিয়ে মামলার ফাইল কোন টেবিলে আছে, বা কতদিন লাগবে, তা নিয়ে ফোনে খোঁজ নিতে হয়েছে। মাঝে মাঝে নিজেও কোর্টে এসেছি। আর এখানে আসলেই টাকা। টাকা ছাড়া ফাইল কবে হাতে পাবো, তার নিশ্চয়তাও কম।’’ তিনি বলেন, ‘‘যদি ই-ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম পদ্ধতি চালু থাকতো, তাহলে আদেশের কপিটি কোন অবস্থায় কোন টেবিলে আছে, তা ঘরে বসেই ধারণা নিতে পেতাম। আবার হয়রানি ও অযাচিত খরচ থেকেও রক্ষা পেতাম। সেকশনগুলোও জবাবদিহির মধ্যে আসতো।’’
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার ঐতিহাসিক “মাসদার হোসেন মামলার” প্রধান বাদী, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য মো. মাসদার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘কোরিয়া, তুরস্কসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বিচার বিভাগ ডিজিটালাইজড হয়েছে। সেখানে অনলাইনে মামলা করা, আপডেট পাওয়া, নথি-পত্রের যাবতীয় তথ্য বিচারপ্রার্থীরা ঘরে বসেই জানতে পারছেন। তাদের দিকে দেখলে আমরা এখনও বহুগুণ পিছিয়ে আছি।’’
উন্নত দেশের বিচার বিভাগ যে পর্যায়ে আছে, আমরা সে তুলনায় তাদের ধারেকাছেও নেই বলেও আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘ই-ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু হলে বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি শুধু নয়, এতে আমরা আইনজীবীরাও লাভবান হবো। বিচারপ্রার্থীদের অতিরিক্ত ফোন কল রিসিভ করতে হবে না। তারা (বিচারপ্রার্থীরা) বা আমরা (আইনজীবীরা) যেকোনও স্থানে বসেই ফাইলের আপডেট জানতে পারবো।’’
ই-ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম কী
আইটি বিশেষজ্ঞ সাকেরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে বর্তমানে ‘মাই গভ’ সার্ভিস চালু রয়েছে, যা দিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে করা আবেদন ও আবেদন নিষ্পত্তির সময়সীমা সম্পর্কে নাগরিকরা ঘরে বসেই দেখতে পাচ্ছেন। মূলত ই-ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম হলো—আমি লগইন করে জেনে যাবো, আমার ফাইল ঠিক কোন টেবিলে কতদিন ধরে রয়েছে এবং ফাইলটির কাজ শেষ হতে সর্বোচ্চ কতদিন প্রয়োজন। এতে করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা যাবে। ধরে নিন, এর ফলে ফাইল হারানো বা অযাচিত সময়ক্ষেপণ হ্রাস পাবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘বর্তমানে ‘মাই গভ’-এর মতো ই-ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা নিজের আইডি ব্যবহার করে কোর্টে প্রবেশ, মামলার জজ পরিবর্তন বা মামলার পর্যায়ক্রমসহ নানান তথ্য ঘরে বসেই নিতে পারছেন। আমাদের দেশেও ই-ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম করা গেলে বিচার বিভাগ ও বিচারপ্রার্থীরা শুধু নন, একইভাবে আইনজীবীরাও সুবিধাভোগী হবেন এবং সবার হয়রানি লাঘব হবে।’’
এই বিষয়ে দক্ষ জনবলের দরকার আছে কিনা, জানতে চাইলে সাকেরুজ্জামান বলেন, ‘‘এজন্য কর্মকর্তাদের ২/১ দিনের প্রশিক্ষণই যথেষ্ট। তাছাড়া এটি ব্যবহার করা এতটাই সহজ— কেউ যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চালাতে অভ্যস্ত থাকেন, শুধু সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি শুধু লগইন করে, তার হাতে থাকা ফাইলের তথ্য আপডেট করে দিতে পারবেন। আর অন্যপ্রান্ত থেকে যে কেউ লগইন করে তার ফাইলের সর্বশেষ অবস্থান দেখে নিতে পারবেন।’’
মামলা ফাইলিং থেকে আদেশ অনুলিপি হাতে পাওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের সেকশনগুলোর কাজ মূলত আইনজীবীদের সহকারীরাই (ক্লার্ক) করে থাকেন। এ বিষয়ে কথা হয় একজন আইনজীবীর সহকারী আব্দুর রহমান খানের সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘জামিন সংক্রান্ত আবেদনগুলো নিয়ে আমাদের বেশি চাপ নিতে হয়। আদেশ হওয়ার পর বিচারপ্রার্থীরা দ্রুত আদেশের অনুলিপি হাতে পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে কাজের চাপও অতিরিক্ত বেড়ে যায়।’’
১২টিরও বেশি টেবিলে ঘুরে আদেশের কপি
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা জানায়, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে দেওয়ানি আপিল-রিভিশন, ফৌজদারি আপিলের বিবিধ আবেদন, রিট, কোম্পানি-বিষয়কসহ বেশকিছু অধিক্ষেত্রের মামলা করা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়ে জামিন সংক্রান্ত বিষয়ে। জামিন সংক্রান্ত মামলাগুলোর ক্ষেত্রে হাইকোর্টের মৌখিক আদেশের পর সেই আদেশটি সংশ্লিষ্ট কোর্টের বেঞ্চ অফিসার (বিও) টাইপ করেন। টাইপের পর সিঙ্গেল বেঞ্চ হলে একজন বিচারপতি ও ডিভিশন বেঞ্চ হলে দুজন বিচারপতির সই দরকার হয়। এরপর ফাইলটি আবার বেঞ্চ অফিসারের টেবিলে ফেরত আসে। সেখানে আদেশের কপির বিষয়টি খাতায় এন্ট্রি করা হয়। এরপর কোর্ট পিয়নের মাধ্যমে সেটি আদালতের সেকশনে পাঠানো হয়। সেকশন থেকে আদেশের অনুলিপিটি গ্রহণ করার পর সেখানে আদেশের কপিটি পুনরায় টাইপ (অধস্তন আদালতে পাঠানোর জন্য) করা হয়। এরপর টাইপ করা ফাইলটির ভুলত্রুটি চেক করা হয়। পরে ফাইলটির দায়িত্বে থাকা প্রশাসনিক কর্মকর্তা আদেশের অনুলিপিতে আদেশ পাঠানোর তারিখ, সেকশন সুপারিনটেনডেন্টের সিল দিয়ে ফাইলটি সুপারের টেবিলে দেওয়া হয়। সুপার ফাইলটি চেক করার পর তাতে সই করেন। সেখান থেকে ফাইলটি সংশ্লিষ্ট অ্যাসিস্টেন্ট রেজিস্ট্রারের (এআর) কাছে পাঠানো হয়। ফাইলে ভুল না থাকলে এআর ফাইলটিতে সই করেন, নয়তো ফাইলটি পুনরায় সেকশনে কারেকশনের জন্য পাঠিয়ে দেন।
অ্যাসিস্টেন্ট রেজিস্ট্রার সই করার পর ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে আদেশের কপিটি স্ক্যানিংয়ের জন্য আইটি শাখায় পাঠানো হয়। তবে রিট বা সিভিল মামলায় এ ধরনের স্ক্যানিং ধাপ নেই। ফৌজদারি মামলার আদেশ স্ক্যানিং শেষে পুনরায় আদেশের অনুলিপিটি সেকশনে চলে আসে। সেকশন থেকে আদেশের অনুলিপিটি ডেসপাস শাখায় চলে যায়। এই শাখায় আদেশের কপিতে একটি মেমো নম্বর দেওয়া হয় এবং সেটি সরকারি ডাকে পাঠানোর জন্য কোর্ট প্রাঙ্গণে থাকা পোস্ট অফিসের শাখায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে আদেশের কপিতে জিপি বা স্মারক নম্বর পরে। দুপুর ১২টার মধ্যে ডাক পাঠাতে পারলে আদেশের কপিটি সংশ্লিষ্ট অধস্তন আদালতে পৌঁছাতে প্রায় দুদিন লেগে যায়।
অর্ডার পাসের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগতে পারে। জামিনের আদেশের ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে জনপ্রতি ৪৫ টাকা নির্ধারিত থাকলেও বিচারপ্রার্থীরা ‘তদবির’ করলে ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৭ দিনের মধ্যে অর্ডারের অনুলিপি পাওয়া যায়। জানা যায়, তদবিরের পেছনে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা খরচ হয়ে থাকে। এরপরও আইনজীবী ও আইনজীবীর সহকারীকেও ফি দিতে হয় বিচারপ্রার্থীদের।
‘ই-ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম’ চালু হলে তা সেকশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহি বাড়বে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘এমন সিস্টেম চালু করার উদ্যোগ নিলে ভালো হবে। এটা বিচার বিভাগের মর্যাদা বাড়াবে। বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে এবং সেকশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহি বাড়বে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পাওয়ার পর তার ঘোষিত রোডম্যাপ অনুসারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে সংস্কার করে চলেছেন।’’
তিনি বলেন, ‘‘বিচার বিভাগের সেকশনগুলোতে বিচারপ্রার্থীদের কিছুটা হলেও যে হয়রানি নেই, তাতো বলতে পারি না। তবে এ থেকে পরিত্রাণও দরকার। নিঃসন্দেহে আমিও চাইবো বিচার বিভাগ এমন একটি সিস্টেমের আওতায় আসুক।’’