বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রবণতা বাড়ছে। তবে সেই আগ্রহের ধরনে এসেছে বড় পরিবর্তন। আগে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়া ছিল শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে পছন্দের দেশ, এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে চীন।
চীনে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে নানা কারণে—টিউশন ফি তুলনামূলক কম, জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক কম, সরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে রয়েছে উদার বৃত্তির সুযোগ, আর এখন পাওয়া যাচ্ছে খণ্ডকালীন কাজের অনুমতিও।
এসব মিলেই বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে চীন এখন উচ্চশিক্ষার বড় গন্তব্য।
ভিসা জটিলতা ও ব্যয়বহুল জীবন—পশ্চিমা দেশ থেকে চীনের দিকে ঝোঁক : কয়েক বছর আগেও ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিতে চাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওই সব দেশে ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বৈশ্বিক ভিসা নীতিতে কঠোরতা এসেছে।
ইউরোপের অনেক দেশেও প্রক্রিয়া জটিল।
জার্মান দূতাবাসের তথ্য মতে, তারা বছরে সর্বোচ্চ দুই হাজার ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া করতে পারে, অথচ জমা পড়ে তার প্রায় ৪০ গুণ। ফলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অনেকেই অপেক্ষা করতে করতে অন্য বিকল্প খুঁজছেন।
অন্যদিকে ইউরোপে পড়তে গেলে ভারত হয়ে ভিসা প্রক্রিয়া করতে হয়।
কিন্তু ভারতের ডাবল-এন্ট্রি ভিসা এখন কঠিন হওয়ায় ইউরোপে পড়তে যাওয়া আরো জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় তুলনামূলক সহজ প্রক্রিয়া, কম খরচ ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চীনের দিকে শিক্ষার্থীদের টেনে নিচ্ছে।
চীনে বাড়ছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অল্টারনেটিভসের ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, চীন এখন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে পছন্দের উচ্চশিক্ষার গন্তব্য। ২০২২ সালে যেখানে ৪২.৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থী চীনে পড়তে আগ্রহী ছিলেন, ২০২৩ সালে সেই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯.১ শতাংশে।
জরিপে দেখা যায়, ৭৫ শতাংশ অভিভাবক ও শিক্ষার্থী ব্যক্তিগতভাবে চীনে পড়তে যেতে বা সন্তানকে পাঠাতে আগ্রহী।
চীনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও বেড়েছে; ২০২২ সালে যেখানে ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা চীন সম্পর্কে ইতিবাচক মত পোষণ করেছিলেন, ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৬৭ শতাংশ।
ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫৫টি দেশে পড়াশোনার জন্য গেছেন ৫২ হাজার ৭৯৯ শিক্ষার্থী। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ২৪ হাজার ১১২। অর্থাৎ ১০ বছরে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি।
তবে শিক্ষার্থী পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, বাস্তবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি—বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ এখন চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন।
জার্মানিভিত্তিক অনলাইন পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিসটা বলছে, চীনে যতসংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন, এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। ২০২২ সালে প্রায় ১১ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী চীনে পড়াশোনা করেছেন। এখন সেই সংখ্যা দ্বিগুণের কাছাকাছি হতে পারে বলে ধারণা করছে বাংলাদেশি স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রযুক্তি, চিকিৎসা ও ব্যবসায় শিক্ষায় আগ্রহ বেশি
চীনে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে প্রকৌশল, তথ্য-প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিষয়ে।
যুক্তরাজ্যের টাইম হায়ার এডুকেশনের ‘ওয়ার্ল্ড এডুকেশন র্যাংকিং ২০২৬’-এ চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে ধারণা পাওয়া যায়। এই র্যাংকিংয়ে অংশ নেয় ১১৫টি দেশের দুই হাজার ১৯১টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে সেরা ৪০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পাঁচটিই চীনের। আর টপ ১০০-এর মধ্যে চীনের বিশ্ববিদ্যালয় সাতটি। র্যাংকিংয়ে চীনের মোট ৯৭টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। চীনের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ছিংহুয়া ইউনিভার্সিটি, পিকিং ইউনিভার্সিটি, ফুদান ইউনিভার্সিটি, ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়, সাংহাই জিয়াও টং বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব চায়না, নানজিং ইউনিভার্সিটি অন্যতম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য চীন বড় গন্তব্য না হওয়ার কোনো কারণ নেই। চীনের অর্থনীতি ইউরোপের অনেক দেশ মিলিয়েও বড়। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ব্যাবসায়িক সম্পর্কও গভীর। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রযুক্তিনির্ভর, খরচ কম, স্কলারশিপের সুযোগও বেশি—তাই আগামী দিনগুলোতে চীনে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো বাড়বে।’
চাকরি ও খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ
আগে চীনে বিদেশি শিক্ষার্থীরা কাজ করতে পারতেন না। তবে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নিয়মে শিথিলতা আনা হয়। এখন তাঁরা সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত খণ্ডকালীন কাজ করতে পারেন। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্থ উপার্জনের একটি নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে।
চীনে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সাইফ রহমান বলেন, ‘রেস্টুরেন্টে কাজ করলে সপ্তাহে পাঁচ-সাত হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়। এতে নিজের খরচ অনেকটাই উঠে আসে। অনেক বাংলাদেশি আবার পর্যটক গাইড হিসেবেও কাজ করেন। চীনে পড়াশোনার ব্যয় তুলনামূলক কম, ফলে পরিবার থেকে পাঠানো টাকায়ও ভালোভাবে পড়ালেখা চালানো যায়।’
জীবনযাপন ব্যয় ও শিক্ষার পরিবেশ
চীনের বড় শহর বেইজিং, সাংহাই বা গুয়াংজু তুলনামূলক ব্যয়বহুল হলেও ছোট ও মাঝারি শহরগুলোতে খরচ অনেক কম। শিক্ষার্থীদের মতে, ঢাকার মতো খরচে চীনের ছোট শহরে ভালোভাবে থাকা যায়। মাসে খাবার খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা, হোস্টেল ফি ছয় থেকে আট হাজার টাকার মতো।
বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য রান্নাঘর রয়েছে, ফলে নিজের পছন্দমতো রান্না করা যায়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান, তবে শিক্ষার্থীদের প্রথম বছরে চীনা ভাষার কোর্স করতে হয়—যা পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ ও চাকরির ক্ষেত্রে কাজে আসে।
বৃত্তির সুযোগে বড় আকর্ষণ
চীনে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন স্কলারশিপের সুযোগে। সবচেয়ে জনপ্রিয় চীনা সরকারি বৃত্তি (সিএসজি) ছাড়াও রয়েছে বেল্ট অ্যান্ড রোড স্কলারশিপ, মফকম বৃত্তি, ও বিভিন্ন এন্টারপ্রাইজ স্কলারশিপ।
২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে চীনা সরকারের বৃত্তি পেয়েছেন ৫৫ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, আর ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮০।
চীনে পড়তে গেলে স্নাতক পর্যায়ে আবেদন করতে হয় উচ্চ মাধ্যমিক সনদ নিয়ে, স্নাতকোত্তরের জন্য স্নাতক ও পিএইচডির জন্য স্নাাতকোত্তর ডিগ্রিসহ প্রয়োজনীয় ভাষাদক্ষতার প্রমাণপত্র।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিভাগের পরিচালক জেসমিন পারভিন বলেন, ‘চীনে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা স্পষ্টভাবে বাড়ছে। প্রযুক্তিতে তারা অনেক এগিয়ে, ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে, খরচও কম। ইউজিসিতে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি চীনা ডিগ্রির সমতা যাচাইয়ের আবেদন আসছে—এটি চীনে শিক্ষার্থী বাড়ারই ইঙ্গিত দেয়।’
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে চীন এখন কেবল সাশ্রয়ী গন্তব্য নয়, বরং একটি ভবিষ্যিনর্ভর সিদ্ধান্ত। চীনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর অনেকেই সেখানে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে চাকরি করছেন, কেউ কেউ দেশে ফিরে উদ্যোক্তা হচ্ছেন। বাংলাদেশের বাজারে চীনা প্রযুক্তি ও ব্যবসা ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে, ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য এই অভিজ্ঞতা নতুন সম্ভাবনার পথ খুলে দিচ্ছে।
সব মিলিয়ে, তথ্য-প্রযুক্তি, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও ব্যবসায় শিক্ষার জন্য চীন এখন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বাস্তবসম্মত গন্তব্য হয়ে উঠেছে।