লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার পরিতোষ সাহার মেয়ে নিপা সাহার বয়স মাত্র ১৬ বছর। ২৪ অক্টোবর অজ্ঞান হয়ে পড়লে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানান নিপা স্ট্রোক করেছে। নিপার স্বজন পরশ সাহা বলেন, ‘উন্নত চিকিৎসার জন্য লালমনিরহাট থেকে ১২ ঘণ্টা রাস্তা পাড়ি দিয়ে নিপাকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস) হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসকরা জানান অবস্থা সংকটাপন্ন। দ্রুত ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। কিন্তু শয্যা ফাঁকা না থাকায় ওই হাসপাতালে ভর্তি করতে পারিনি।’
চিকিৎসকরা বলছেন, সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে অনেক ক্ষেত্রেই স্ট্রোক থেকে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি মেকানিক্যাল থ্রোমবেক্টমির মাধ্যমে স্ট্রোকের মৃত্যুঝুঁকি কমানো সম্ভব। তবে দেশে এখনো এ চিকিৎসা সহজলভ্য নয়। এ প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘প্রতিটি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ’।
নিয়মিতভাবে মেকানিক্যাল থ্রোমবেক্টমি হচ্ছে শুধু ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসে (নিনস)। অল্প পরিসরে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল ও ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কল্যাণপুরে এ চিকিৎসা দেওয়া হয়।
নিনসের স্ট্রোক ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্ট্রোকের ক্ষেত্রে প্রতিটি মিনিটই মূল্যবান। যত দ্রুত বন্ধ রক্তনালি খুলে দেওয়া যায়, তত বেশি কোষ বাঁচানো সম্ভব। মেকানিক্যাল থ্রোমবেক্টমি মস্তিষ্কের বড় অংশকে বাঁচাতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ চিকিৎসা পদ্ধতিটি মূলত ছোটখাটো একটি অপারেশন, যা করা হয় ক্যাথল্যাবে। যেমন হার্ট অ্যাটাকের সময় রোগীকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে বন্ধ ধমনিতে স্টেন্ট বসিয়ে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক করা হয়, তেমন মেকানিক্যাল থ্রোমবেক্টমির মাধ্যমে মস্তিষ্কের বন্ধ রক্তনালি খুলে দেওয়া হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সফলভাবে মেকানিক্যাল থ্রোমবেক্টমি করা রোগীদের ৫০ শতাংশ পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়, আর মৃত্যুহার কমে মাত্র ১০ শতাংশে। আগে মনে করা হতো স্ট্রোকের ৬ ঘণ্টার মধ্যে এ চিকিৎসা কার্যকর। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ১৬ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যেও অনেক ক্ষেত্রে মেকানিক্যাল থ্রোমবেক্টমি কার্যকর হতে পারে।’ দেশে প্রতি ১ হাজারের মধ্যে প্রায় ১৩ দশমিক ৬ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। আশঙ্কার বিষয় হলো, এর মধ্যে ২৩ শতাংশ রোগীর বয়স ৫০ বছরের কম। অর্থাৎ প্রতি চারজন স্ট্রোক রোগীর একজনের বয়স ৫০-এর নিচে। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ পরিচালিত এ গবেষণার তথ্য বলছে, ৬০ থেকে ৬৯ বছর বয়সি মানুষের মধ্যে স্ট্রোকের হার সবচেয়ে বেশি। এ বয়সসীমার ২৮ শতাংশ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্ট্রোকের হার বাড়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে চাপের জীবনযাত্রা, ফাস্টফুড খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম কম করা এবং ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি অন্যতম।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাত জাগা, সকালবেলার ঘুম বাদ দেওয়া এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে তরুণদের মধ্যে স্ট্রোকের হার বাড়ছে।’
এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে স্ট্রোকের চিকিৎসায় ঘাটতি রয়েছে। এজন্য সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে আট বিভাগীর শহরে ক্যানসার, কিডনি, হৃদরোগের চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল করা হচ্ছে। স্ট্রোকের চিকিৎসায়ও ভাবতে হবে। এ হাসপাতালগুলো চালু হলে নিউরো সমস্যায় ভুগছে কিংবা স্ট্রোক করেছে এমন রোগীদের চিকিৎসায় নজর বাড়ানো হবে।’