দেশের প্রথম মেট্রোরেল লাইনের একই এলাকায় এক বছর পার হতে না হতেই দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় রাজধানীবাসীর কাছে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই গণপরিবহনের নিরাপত্তা মান ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও প্রথম পর্যায়ে রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল করা মেট্রোরেলের ট্র্যাক (চলাচলের পথ) ও কারিগরি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো আর্থিক বরাদ্দ রাখেনি সরকার। অথচ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে মেট্রোরেলের উন্নয়ন ব্যয় বাবদ জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে চার হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের জন্য পরিচালন ব্যয়ের বরাদ্দ কমানো হয়েছে। প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার এই অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণে পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কোম্পানির জন্য এক টাকাও বরাদ্দ না রাখাকে অদক্ষতা ও অযোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে দেখছেন যোগাযোগ ও প্রকৌশল খাত বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ডিএমটিসিএলের জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। আর চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে ডিএমটিসিএলের মোট খরচে রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ছিল না কোনো বরাদ্দ। একই ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি।
রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ না থকার কারণ হিসেবে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ বলছে, এখনো প্রকল্পটি ঠিকাদারের পর্যালোচনায় থাকায় কোম্পানি থেকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা করে বেশি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে না। সেসব সমস্যা চিহ্নিত হয় সেগুলো ঠিকাদারের অর্থায়নেই ঠিক করা হয়। যদিও যোগাযোগ অবকাঠামো ও প্রকৌশল খাতের বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, বড় সমস্যা দেখা দিলে ‘ডিফেক্ট লায়াবেলিটি প্রিয়ড’ সময়কালে তা ঠিকাদারই ঠিক করে দেবে। কিন্তু এই সময়কাল পার হওয়ার পর যাতে বড় কোনো সমস্যা তৈরি না হয় সেজন্য ডিএমটিসিএলকে তো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। ‘ডিফেক্ট লায়াবেলিটি প্রিয়ড’ শেষে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় কে নেবে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ডিএমটিসিএলের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট চূড়ান্ত হয়েছে চলতি অক্টোবরে। তবে সেটি জুলাই থেকে কার্যকর দেখানো হচ্ছে। চার মাস পর বাজেট চূড়ান্ত হলে খরচ হবে কবে সেই প্রশ্নও উঠছে। চলতি অর্থবছরে ডিএমটিসিএলের প্রস্তাবিত পরিচালন বরাদ্দ ছিল ২৭০ কোটি টাকা। তবে সেটি কমিয়ে ২১৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। বাজেট কমানোর এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে ডিএমটিসিএলের পরিচালনা পরিষদ।
গত রোববার রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেল পথের খুঁটি ও উড়াল পথের সংযোগস্থল থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড সরে নিচে পড়ে যায়। খসে পড়া বিয়ারিং প্যাডের ওজন ছিল ৮০ কেজি। এটির আঘাতে এক পথচারীর মৃত্যু হয়েছে, আহত হন আরও দুজন। রক্ত ঝরানো এই দুর্ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বর্তমান সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রউফকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার ডিএমটিসিএলে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত অন্তত পাঁচ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে কালবেলা, সেই আলোচনায় পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার আক্ষেপ করেন তারা। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করার ইস্যুতে বিভিন্ন সভায় আলোচনা হলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি বলে জানান এসব কর্মকর্তা। অবসরে যাওয়া এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘পরিচালনা পরিষদের সর্বশেষ কয়েকটি সভায় রক্ষণাবেক্ষণকে গুরুত্ব দিতে আলোচনায় তোলা হয়। কিন্তু তাতে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুখ আহামেদ কোনো সাড়া দেননি। এমনকি যেভাবে চলছে সেভাবে চলার দিকেই তিনি জোর দেন।’
আরেক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘পরিচালনা পরিষদের সর্বশেষ সভাতেও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। কিন্তু গুরুত্ব না পাওয়ায় সভার কার্যবিবরণীতে তা আর উল্লেখ করা হয়নি।’
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ডিএমটিসিএলের পরিচালনা পরিষদের ৭১তম সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক। তিনি বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। সেই সভার কার্যবিবরণীর আলোচ্যসূচি-২-এ বাজেট সংক্রান্ত আলোচনা করা হয়। তার আগে গত ২৩ জুলাই ৭০তম সভায় ডিএমটিসিএলের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের ওপর ভিত্তি করে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ২৭০ কোটি ২২ লাখ ৫৫ হাজার টাকার খসড়া বাজেট প্রণয়ন করে অডিট ও ফিন্যান্স কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়। পরে গত ৮ সেপ্টেম্বর অডিট ও ফিন্যান্স কমিটির সভায় খসড়া বাজেট বিশ্লেষণ করে চলতি অর্থবছরের জন্য ২১৫ কোটি ২২ লাখ চার হাজার টাকা প্রাক্কলন হয়। এটি আগামী ডিসেম্বরে সংশোধনী বাজেট প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করা হয়।
এ বিষয়ে কালবেলার এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুখ আহামেদ বলেন, ‘রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ কম। তবে একেবারে বরাদ্দ নেই, এটা ঠিক না। বরাদ্দ কত আছে তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। এখনও যেহেতু ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড চলছে। তাই রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমাদের ভাবতে হচ্ছে না। কারণ এই সময়ে রক্ষণাবেক্ষণ না, রিপেয়ার হবে। আগামী বছর থেকে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড শেষ হয়ে গেলে মেইনটেনেন্সে বরাদ্দ অন্তত তিনগুণ বাড়বে।’
যদিও ডিএমটিসিলের সংশ্লিষ্ট শাখার একাধিক কর্মকর্তা রক্ষণাবেক্ষণ খাতে আর্থিক বরাদ্দ না থাকার বিষয়টি কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন।
রোববারের রক্তক্ষয়ী দুর্ঘটনার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘এটা পুরোপুরি দুর্ঘটনা। চার কারণে এমনটা হতে পারে—নকশায় ত্রুটি থাকতে পারে; অবকাঠামো নির্মাণে ত্রুটি থাকতে পারে; নির্মাণসামগ্রীর গুণগত মান ভালো না হতে পারে এবং নির্মাণকাজের তদারকিতে দুর্বলতা থাকতে পারে।’ এ দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণের কথা উল্লেখ না করার কারণ জানতে চাইলে ফারুখ আহামেদ বলেন, ‘রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত হচ্ছে, এতে কোনো কমতি নেই।’
আলোচিত এ দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে গঠিত তদন্ত কমিটির এক সদস্যের সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। তিনি বলেন, ‘ফার্মগেট মেট্রো স্টেশন তিনতলা, আর বিজয়সরণি মেট্রো স্টেশন দ্বিতল। স্বাভাবিকভাবে দেখলে মনে হবে এখানে একটা কার্ভ (ঢালু ও বাঁকা) আছে। এই অংশেই দুবার এমন ঘটনা (বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়া) ঘটল। তাই বলে এই কার্ভ থাকাটাকে দোষের মনে হচ্ছে না। এখানটাই কম্পন কেমন হবে—সেটা ভাবনায় রেখেই নিশ্চয়ই ডিজাইনটা (নকশা) করা হয়েছে। আরেকটা বিষয়, ২০০ টন ওজনের ভায়াডাক্টের (উড়াল পথের অংশ) নিচে চাপা থাকার পরেও বিয়ারিং প্যাড কীভাবে সরতে পারে, এটা রীতিমত গবেষণার বিষয়। বিয়ারিং প্যাড তিন দিনে সরেছে, নাকি তিন মাসে সরেছে, তা পর্যালোচনা না করে বলা কঠিন।’
এর আগে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের ৪৩০ নম্বর খুঁটি থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। এবার মাত্র তিন খুঁটির ব্যবধানে আবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটল।
জানতে চাইলে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. শামছুল হক দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ডিএমটিসিএলের অভ্যন্তরে একটি শক্তিশালী, প্রকৌশলী নেতৃত্বাধীন রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট গঠন করতে হবে, যারা প্রতি ছয় মাসে দৃশ্যমান পরিদর্শন ও প্রতি বছর লোড টেস্ট পরিচালনা করবেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নিতে পারবেন।’
রোববারের দুর্ঘটনাসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘রক্ষণাবেক্ষণ কাজে কোনো বাজেট নেই, সেটা আমার জানা ছিল না। ঠিকাদার এখনো কাজ করছে কি না, সেটাও জানি না। করলে তাদেরও দায় নিতে হবে। তবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ডিএমটিসিএলের নিজস্ব কোনো টিম নেই। সেটি তৈরি করতে হবে, বাজেট বাড়াতে হবে। আমাদের সক্ষমতা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বছরে অন্তত একবার বিদেশ থেকে একটি টিম এনে পুরো সাইট পরীক্ষা করাতে হবে।’