জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ২২টি নোট অব ডিসেন্টসহ (বিভিন্ন দলের আপত্তি) সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ সংক্রান্ত বিশেষ আদেশ জারি করা হবে। যার শিরোনাম হবে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ ২০২৫।’ এর ভিত্তি হবে ‘২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান। নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসাবে এতে স্বাক্ষর করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সোমবার ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ড. ইউনূস। যিনি কমিশনেরও সভাপতি। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় কমিশনের সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা হবে। শিগগিরই জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সনদে স্বাক্ষর করতে পারে বলে ঐকমত্য কমিশন সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে ৩১ অক্টোবর। এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ঐকমত্য কমিশনের ডকুমেন্ট ইতিহাসের চিরজীবন্ত দলিল।
সূত্র জানায়, সুপারিশে বলা হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রথমে আদেশ জারি করবে সরকার। আবার আদেশের মধ্যে অধ্যাদেশের কথা উল্লেখ রয়েছে। জুলাই আদেশের পরিশিষ্টে সনদের ৮৪টি প্রস্তাবই উল্লেখ রয়েছে। আদেশ জারির পর বেশ কিছু সুপারিশ দ্রুত অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়ন হবে। আর চূড়ান্ত আইনি ভিত্তি দিতে এই আদেশের ওপর হবে গণভোট। এতে ভোটারদের কাছে প্রশ্ন থাকবে, আপনি জুলাই আদেশ সমর্থন করেন কিনা। ভোটাররা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ সমর্থন দেবে। হ্যাঁ জয়যুক্ত হলে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি)সহ পুরো সনদ বাস্তবায়ন হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচিত সংসদকে ৯ মাস বা ২৭০ দিনের মধ্যে সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যদিকে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার দুটি দায়িত্ব পালন করবে। প্রথমত, দায়িত্ব সংবিধান সংস্কার পরিষদের। অর্থাৎ ৯ মাসের মধ্যে সনদে উল্লিখিত সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে। পরবর্তী ৪ বছর ৩ মাস, সংসদ নিয়মিত আইনসভা হিসেবে কাজ করবে। তবে গণভোট জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একইদিনে, না আগে সেটি সরকার নির্ধারণ করবে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে সরকার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ করেছে। নির্বাচন কমিশনের দুই ধরনেরই প্রস্তুতি রয়েছে।
জানতে চাইলে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, মঙ্গলবার বেলা ১২টায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে জুলাই সনদ সুপারিশ জমা দেওয়া হবে। বিশেষ আদেশে সনদ বাস্তবায়ন হবে। এই আদেশের ভিত্তি হবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সুপারিশ সরকারপ্রধান আদেশে স্বাক্ষর করবেন। বাকিটা ওনারা সিদ্ধান্ত নেবেন। গণভোটের তারিখের ব্যাপারে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের সুনির্দিষ্ট কোনো সুপারিশ নেই। গণভোট কখন হবে সে সিদ্ধান্ত সরকার নেবে।
সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি থাকছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ থাকবে। বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। শেষ মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের চাপ ছিল কিনা জানতে চাইলে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, আমাদের ওপর কোনো ধরনের চাপ নেই এবং ছিল না। স্বাধীনভাবে কাজ করেছি আমরা। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার সনদ বাস্তবায়ন না করলে তাদের বাধ্য করার জন্য কী থাকছে এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, বাধ্য করা এই শব্দটির সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ জুলাই সনদ তৈরিতে দলগুলো আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সনদে স্বাক্ষর করেছে। দলগুলো দেশের মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, দলগুলোর ভেতরে মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোই সনদ তৈরির মূল অংশীজন। ফলে বাস্তবায়ন না করার কোনো বিষয় নেই।
সূত্র জানায়, সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের তিনটি অংশ। কিছু প্রস্তাব নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা যায়। কিন্তু প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করতে হবে। তবে সনদের বড় অংশই বাস্তবায়ন করতে সংবিধান সংশোধন হবে। এক্ষেত্রে সংবিধানের মৌলিক বিষয় সংশোধন করতে গণভোট লাগবে। এ নিয়ে প্রায় বছরব্যাপী আলোচনা চলেছে। শেষ পর্যন্ত জুলাই অভ্যুত্থানকে ভিত্তি ধরে বিশেষ আদেশে গণভোট বাস্তবায়নের সুপারিশ এসেছে। এরপর জনগণের সম্মতির জন্য বিষয়গুলো গণভোটে যাবে। সূত্র আরও জানায়, বিশেষজ্ঞরা আগে সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোট আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
যেহেতু সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের ক্ষমতা সংসদের নেই, তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনকে গণভোটের মাধ্যমে কন্সটিটুয়েন্ট (গাঠনিক) ক্ষমতা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ওই অধিবেশনের নাম হবে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’। গণভোটে অনুমোদিত জুলাই সনদ অনুযায়ী ওই অধিবেশন সংবিধানের সংস্কার করবে। সূত্র আরও জানায়, জুলাই আদেশ হবে সংবিধানের সমতুল্য। আর গণভোটের মাধ্যমেই তা চূড়ান্ত রূপ পাবে। এক্ষেত্রে জুলাই সনদ নয়, গণভোট হবে জুলাই আদেশের ওপর। এই আদেশ পাশ হলে সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে। তবে যেসব বিষয়ে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট আছে, সেগুলোও কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে বাস্তবায়ন হবে। এক্ষেত্রে সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব), একজন ব্যক্তির তিন পদে (নির্বাহী বিভাগের প্রধান, সংসদ নেতা ও দলের প্রধান) না থাকা এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ব্যাপারে কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে চায়। এর সবকিছুই আদেশে রয়েছে।
সূত্র জানায়, ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৪৭টি সংবিধান সম্পর্কিত। এগুলো বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এর মধ্যে সনদ সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে কমিশন। সূত্র জানায়, আদেশ জারির পর এর কিছু অংশ তাৎক্ষণিক এবং কিছু কিছু বিষয় পরবর্তী সময়ে কার্যকর হবে। আদেশের কোন ধারা কবে কার্যকর হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া থাকছে। সংস্কার প্রস্তাবগুলো একটি বিল আকারে উপস্থাপন করে তার ভিত্তিতে গণভোট করার বিকল্প সুপারিশ রয়েছে। তবে বিতর্ক অন্য জায়গায়। বিএনপি বলছে, আদেশ জারির ক্ষমতা বর্তমান সরকারের নেই। কারণ এটি বিপ্লবী সরকার নয়। বর্তমান সংবিধান মেনেই সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের রেফারেন্স নিয়ে গঠিত হয়েছে। ফলে সরকার সংবিধান সমতুল্য আদেশ দিতে পারেন না। দলটির বক্তব্য রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ দিয়ে অথবা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গণভোট দিতে পারেন।
প্রসঙ্গত জুলাই সনদ ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। গত ১৭ অক্টোবর বিএনপি, জামায়াতসহ ২৪টি দল সনদে স্বাক্ষর করেছে। পরের দিন স্বাক্ষর করে গণফোরাম। অর্থাৎ ২৫টি দল ইতোমধ্যে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের অন্যতম অংশজন এনসিপি এখনো সই করেনি। দলটি বলছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের লিখিত কপি এবং গণভোটের প্রশ্নটি চূড়ান্ত করে আগেই জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। তবে গণভোটের ব্যাপারে দলগুলো একমত হলেও ভোটের সময় নিয়ে আপত্তি আছে। বিএনপি বলছে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একইদিনে ভিন্ন ব্যালটে হবে। জামায়াত ও এনসিপি বলছে আগে গণভোট, পরে জাতীয় নির্বাচন। এ নিয়ে বর্তমানে মাঠে আন্দোলন করছে জামায়াতসহ ৮ দল। ফলে এই সনদ বাস্তবায়নে সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে সোমবারের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশনের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া ও সফর রাজ হোসেন। এছাড়া সনদ তৈরিতে বিশেষজ্ঞ প্যানেলে কাজ করেছেন। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমএ মতিন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূইয়া, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক এবং ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঐকমত্য কমিশনের সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে মঙ্গলবার। সমাপনী বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের পর থেকে চূড়ান্ত সুপারিশ প্রদান পর্যন্ত সব ডকুমেন্ট, আলোচনার ভিডিও, অডিও, ছবি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘এগুলো মহামূল্যবান সম্পদ। জাতি হিসাবে আমরা কোন প্রেক্ষাপটে কী প্রক্রিয়ায় কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম, তা সবার জন্য দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং উন্মুক্ত থাকা দরকার। যত বৈঠক হয়েছে সেগুলোর ছবি ও ভিডিও, যত চিঠি চালাচালি হয়েছে-সব ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করতে হবে এবং ক্যাটাগরি করে রাখতে হবে। টেলিভিশনে যেসব আলোচনা লাইভ প্রচার হয়েছে সেগুলো খণ্ড খণ্ড আকারে সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ এগুলো হবে ইতিহাসের চিরজীবন্ত দলিল। যারা গবেষণা করতে চায় তারা যেন এগুলো দেখে কাজে লাগাতে পারে। প্রজন্মের পর প্রজন্মে এই ডকুমেন্ট থেকে যাবে। এই দলিলগুলোই ভবিষ্যতের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে,’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন। এ সময় রাজনৈতিক দল, ঐকমত্য কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধান উপদেষ্টা।