দেশের ব্যাংকগুলো থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের পথ বন্ধ হচ্ছে । দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন ও প্রসারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার । এ জন্য একটি বিশেষ কমিটি কাজ করছে । এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে আগামী বছরই ব্যাংকের পরিবর্তে শুধু বন্ড মার্কেট থেকেই দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন চালু করা হবে ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বন্ড মার্কেট থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন একটি স্বীকৃত আন্তর্জাতিক চর্চা । বাংলাদেশও এই চর্চা শুরু করতে চায় । এ জন্যই ব্যাংকের পরিবর্তে বন্ড মার্কেট থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ।
এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নির্দেশনায় একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে । অর্থ মন্ত্রণালয় , বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ( বিএসইসি ), বাংলাদেশ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের ( আইডিআরএ ) সমন্বয়ে গঠিত এই কমিটি বন্ড মার্কেট থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের পদ্ধতি, প্রসার এবং ঝুঁকিসংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে । সরকারও বাংলাদেশে বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন, চ্যালেঞ্জ এবং সুপারিশসংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে । সূত্র জানায় , গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈঠক করেছে বিশেষ এই কমিটি । বৈঠকে বন্ড মার্কেট উন্নয়ন , চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে ।
গভর্নর দেশে না থাকায় ভার্চুয়ালি নানা পরামর্শ দিয়েছেন কমিটিকে । তাঁর পরামর্শের আলোকে বন্ড মার্কেটের নীতিমালা, ঝুঁকি, নিরাপত্তা, গ্রাহকের স্বার্থ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে । গভর্নর দেশে ফিরলে প্রতিবেদন আকারে সুপারিশগুলো জমা দেওয়া হবে । তাঁর কাছে থেকে সংযোজন, সংশোধনী এবং পরামর্শ এলে তা ঠিক করে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে এবং নিয়মমাফিক তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে । সেখানে থেকে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে যাবে সুপারিশমালা । সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী জুন নাগাদ বন্ড মার্কেট থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন শুরু হবে ।
এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড . সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন , বাংলাদেশে বড় বড় প্রকল্পের অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভর না করে পুঁজিবাজারে যেতে হবে । সেখান থেকে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় প্রজেক্ট করা সম্ভব । ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বন্ড মার্কেটকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হবে । বাংলাদেশে ক্যাপিটাল মার্কেট এখনো উন্নত হয়নি জানিয়ে ড . সালেহউদ্দিন বলেন , সরকারি বন্ড সেগমেন্ট থাকলেও সেখানে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ খুবই কম , আর শেয়ারবাজার প্রায় নগণ্য । ফলে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বড় প্রকল্পগুলো ঝুঁকি ভাগাভাগি না করে শুধু ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে । এতে ঋণখেলাপি ও তহবিল অপব্যবহারের ঘটনা ঘটছে , যা দেশের জন্য বড় ট্র্যাজেডি । প্রকৃতপক্ষে ঝুঁকি ভাগাভাগি করতে হলে মানুষকে বন্ড , ডিবেঞ্চার ও শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে । ব্যাংক থেকে শুধু ঋণ নেওয়া এবং পরে তা ভুল খাতে ব্যবহার করা কোনো সমাধান নয় ।
তাই ক্যাপিটাল মার্কেটে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং বিনিয়োগকারীদেরও বুঝতে হবে যে এখানে ঝুঁকি যেমন আছে , তেমনি লভ্যাংশ বা মুনাফার সম্ভাবনাও আছে বাংলাদেশের বন্ড মার্কেট উন্নয়নে গত ১১ মে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় । সেই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ বন্ড মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ : চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড রিকমেন্ডেশন ' শীর্ষক একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে । সেই প্রতিবেদনে বন্ড মার্কেটের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করা হয় । সেই সঙ্গে প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু নিয়ে বাংলাদেশের বন্ড মার্কেট উন্নয়নের লক্ষ্যেই গঠনমূলক আলোচনার প্রয়োজনীয়তার কথা জানানো হয় । এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয় , জাতীয় রাজস্ব বোর্ড , বাংলাদেশ ব্যাংক , বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন , বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ , ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ , ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান , ইনস্যুরেন্স কোম্পানি , ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি , করপোরেট প্রতিষ্ঠান , বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ও থিংকট্যাংকগুলোকে নিয়ে আগামী নভেম্বরের মাঝামাঝি জাতীয় সেমিনারের কথা বলা হয়েছে ।
সেই সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টাকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানিয়ে ৭ অক্টোবর চিঠি দিয়েছেন গভর্নর ড . আহসান এইচ মনসুর । বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন ও প্রসারে গঠিত কমিটির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান , দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হিসেবে পুঁজিবাজারের সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় , তা নিয়ে কাজ চলছে । পুঁজিবাজার থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন তথা পুঁজি উত্তোলনের পুঁজি উত্তোলনের সুযোগকে প্রাধান্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকঋণের ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ ও ঝুঁকি হ্রাসের মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিতের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে । বিশেষ করে দেশের বৃহৎ কোম্পানিগুলোকে ব্যাংকঋণের পরিবর্তে বন্ড ও সিকিউরিটিজ ইস্যুর মাধ্যমে অর্থায়নের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে নানা উদ্যোগে সুপারিশ করা হবে । একই সঙ্গে দেশে একটি প্রাণবন্ত বন্ড মার্কেট প্রতিষ্ঠা ও বন্ড মার্কেটের তারল্য বৃদ্ধি করা হবে ।
আর বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ২০ বছর মেয়াদে সরকারের বন্ড ইস্যু করছে । ঢাকা সিটি করপোরেশনও চাইলে ৩০ বছর মেয়াদি বন্ড ইস্যু করতে পারে । এ ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে । বেসরকারি গবেষণা প্ৰতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও মাসরুর রিয়াজ আজকের পত্রিকাকে বলেন , বাংলাদেশ বন্ড মার্কেটে একেবারে সীমিত । দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়া যায় না বললেই চলে । প্রযুক্তিভিত্তিক আধুনিক শিল্পায়ন এবং বড় শিল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন জরুরি । সে জন্য বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন প্রয়োজন । এটি যত দ্রুত প্রসার হবে , তত বেশি লাভ হবে । বর্তমানে সরকার কিছু বন্ড ছাড়ে , সেটা বাড়াতে হবে । বেসরকারি কোম্পানিকে এগিয়ে আসত হবে । আর বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকে , সেটা মার্কেটেও রয়েছে । এ জন্য সংস্কার ও নীতিমালা করতে হবে । জানা গেছে , বাংলাদেশে মাত্র ১৬ টি করপোরেট বন্ড চালু রয়েছে । আর সুকুক বন্ড রয়েছে ২৩৩ টি । সরকারি বন্ড সেকেন্ডারি মার্কেটে আসেনি ।
সব মিলিয়ে স্টক মার্কেটের বন্ডের মূল্য ৬ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা । তার মধ্যে ইক্যুইটি ৩ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা , সিকিউরিটিজ ২ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা । উল্লেখ্য , দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় পরপর মুনাফা পাওয়া যায় । সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের ক্ষেত্রে সরকারি বন্ড , করপোরেট বন্ড এবং অন্যান্য বন্ড রয়েছে । বন্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে সরকার , ব্যাংক বা করপোরেশন । বন্ড কেনার জন্য একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন । বন্ডের জন্য ন্যূনতম এক লাখ টাকা জমা রাখতে হয় ।