Image description

মেট্রোরেলের একটি পিলারের বিয়ারিং প্যাড পড়ে আবুল কালাম নামে এক পথচারী নিহত হয়েছেন। গতকাল রোববার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে সংশ্লিষ্ট ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তিন ঘণ্টা পর আংশিক চালু হলেও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস হওয়ায় স্টেশনগুলোতে ছিল উপচেপড়া ভিড়।

মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সন্ধ্যায় জানায়, দুর্ঘটনার পর ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তিন ঘণ্টা পর উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সেবা চালু করা হয়। পরে সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়।

এর আগে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর একই এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। তবে সে সময় কেউ হতাহত না হলেও ১১ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। দ্বিতীয়বার এমন দুর্ঘটনার পর ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আবুল কালাম ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় মাথার উপরে মেট্রোরেল চলাচল করছিল। একটি ট্রেন পার হওয়ার মুহূর্তে উপর থেকে পিলারের একটি বিয়ারিং প্যাড মাথায় পড়লে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। সঙ্গে থাকা পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, তার নাম লেখা আবুল কালাম, বাড়ি শরীয়তপুরে। দুর্ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশটি উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়।

দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, নিহত আবুল কালামের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ও তার পরিবারে কর্মক্ষম কেউ থাকলে মেট্রোরেলে চাকরি দেওয়া হবে। এছাড়া দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে।

মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকীর পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তদন্তে কমিটিতে কারিগরি ও প্রকৌশলগত পর্যালোচনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং সামরিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের (এমআইএসটি) বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাহিদুল ইসলাম এবং ডিএমটিসিএলের লাইন-৫-এর প্রকল্প পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল ওহাব। এছাড়া উপসচিব আসফিয়া সুলতানা কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কমিটি গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বরের সংঘটিত দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করতে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা প্রস্তুত এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করবে।

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ বলেন, আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত আপাতত চালু হচ্ছে না। তবে বাকি অংশ কখন চালু হবে, তা পরে জানানো হবে।

দুর্ঘটনার পর হঠাৎ করে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হলে স্টেশনগুলোতে থাকা যাত্রীরা পড়েন বিপাকে। প্রায় তিন ঘণ্টা সেবা বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েন মেট্রোরেল যাত্রীরা। তবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ চালু হলে এই অংশের যাত্রীদের মধ্যে স্বস্তি ফেরে। কিন্তু আগারগাঁও থেকে সেবা চালু না হওয়ায় সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন এই অংশের যাত্রীরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সব পিলারের সঙ্গে রাবারের বিয়ারিং প্যাড থাকে, যার প্রতিটির ওজন ৮০ কেজি। এসব বিয়ারিং প্যাড ছাড়া ট্রেন চালানো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল রুটে আপাতত মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

গ্রামে এসে আর ইলিশ খাওয়া হলো না

আবুল কালামের

রাজধানীর ফার্মগেটে গতকাল রোববারের দুপুরটা ছিল অন্য দিনের মতোই কর্মচঞ্চল। মানুষ যাচ্ছিল অফিসে, কেউ বাজারের পথে। হঠাৎ এক মুহূর্তে থেমে গেল সবকিছু। হঠাৎ মেট্রোরেলের একটি পিলার থেকে ভারী ধাতব যন্ত্রাংশ ‘বিয়ারিং প্যাড’ ছিটকে পড়ে কেড়ে নেয় তরুণ উদ্যোক্তা আবুল কালামের (৩৫) প্রাণ।

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামের জলিল চোকদারের ছেলে আবুল কালাম। নারায়ণগঞ্জের জলকাঠি এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে আবুল কালাম ঢাকায় একটি ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করতেন।

নিহতের মেজো ভাবি আছমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘দুপুর ১২টায় আবুল কালামের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল। সে বলছিল, দুয়েক দিনের মধ্যে বাড়ি আসবে। বলেছিল, আমি যেন ইলিশ মাছ কিনে রাখি আর সে আর ফিরে এলো না।’

নিহতের চাচাতো ভাই আব্দুল গণি চোকদার জানান, আবুল কালাম খুব পরিশ্রমী, ভদ্র স্বভাবের মানুষ। নিজের চেষ্টায় ঢাকায় ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিলেন। এমন আকস্মিক মৃত্যু তাদের জন্য এক অসম্ভব বেদনার বিষয়।

তিনি বলেন, ‘সরকারের অবহেলার কারণে আমার ভাই মারা গেল। এখন তার পরিবারে দায়-দায়িত্ব কে নেবে?’

আবুল কালামের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে আব্দুল্লাহর বয়স পাঁচ বছর আর মেয়ে সুরাইয়া আক্তারের বয়স তিন বছর। স্বজনরা জানান, তিনি ব্যবসায়িক কাজে নিয়মিত ফার্মগেট এলাকায় যাতায়াত করতেন।

সড়ক ও রেল উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান গতকাল দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে জানান, নিহতের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এছাড়া পরিবারের কোনো কর্মক্ষম সদস্য থাকলে তাকে মেট্রোরেলে চাকরিও দেওয়া হবে।