আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনায় স্থানীয় সরকারের এক প্রভাবশালী স্তর- ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও চেয়ারম্যানরা। দীর্ঘদিন ধরে মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে কাজ করা এসব জনপ্রতিনিধি এখনো অনেক ইউপিতে বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করছেন। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে দলটির অবস্থান দুর্বল হলেও তৃণমূল পর্যায়ে তাদের এ উপস্থিতি আগামী নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অনেকেই বলছেন, বর্তমান জনপ্রতিনিধিরা হতে পারেন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের ‘গলার কাঁটা’, যারা স্থানীয় প্রশাসন, ভোটার মনস্তত্ত্ব ও মাঠপর্যায়ের সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকার পতনের পর স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে যান। জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দখলে ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক দিনের মাথায় স্থানীয় সরকার বিভাগকে পরিচ্ছন্ন করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই মেয়র, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে সরকার।
তবে স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে প্রভাবশালী স্তর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও চেয়ারম্যানদের বহাল রাখা হয়। ফলে পালিয়ে থাকা অনেক ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যান পরবর্তীতে ফিরে এসে সমঝোতা করে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এখনো দেশের বিভিন্ন জেলায় শত শত ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যান দায়িত্বে রয়েছেন, যাদের অধিকাংশই অতীতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বা প্রত্যক্ষ সমর্থনে নির্বাচিত।
নির্বাচত জনপ্রতিনিধিদের স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক এবং দীর্ঘদিনের সংগঠনভিত্তিক নেটওয়ার্ক থাকার কারণে তারা নিজ নিজ এলাকায় এখনো কার্যত প্রভাবশালী। গ্রামাঞ্চলে সামাজিক সহায়তা, বিভিন্ন ভাতা বণ্টন, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বা সরকারি ত্রাণ বিতরণ- সব ক্ষেত্রেই তাদের হাতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের দৃঢ় অবস্থান রয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে দলীয় অচলাবস্থা দেখা দিলেও তৃণমূলে জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতি নির্বাচনি পরিবেশে এক ধরনের অঘোষিত ‘ক্ষমতা কাঠামো’ হিসেবে কাজ করতে পারে। ফলে নানা মহলে আলোচানা চলছে ইউনিয়ন পর্যায়ে বহাল থাকা আ.লীগ-সমর্থিত ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানরা আগামী জাতীয় নির্বাচনে কি প্রভাব ফেলতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও চেয়ারম্যানরা গ্রামীণ ভোটব্যবস্থার সবচেয়ে কার্যকর নিয়ামক। তারা শুধু জনপ্রতিনিধিই নন, স্থানীয় পর্যায়ের ‘অপিনিয়ন মেকার’ হিসেবেও কাজ করেন। নির্বাচনের সময় ভোটারদের ওপর প্রভাব বিস্তার, প্রার্থীর প্রচারণা পরিচালনা, এমনকি ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত তাদের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারক হয়ে ওঠে। অতীতে বিভিন্ন নির্বাচনে দেখা গেছে, যেসব এলাকায় চেয়ারম্যানরা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সেখানে সেই দলের প্রার্থী তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থেকেছেন। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে দলীয় নেতৃত্ব দুর্বল হলেও ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানদের মাঠপর্যায়ের প্রভাব আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ভোটের হিসাব পাল্টে দিতে পারে।
অন্যদিকে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের জন্যও ইউপি চেয়ারম্যানদের নিয়ন্ত্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠছে। অনেক জায়গায় অভিযোগ উঠেছে- চেয়ারম্যানরা তাদের পদ ও প্রভাব ব্যবহার করে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক স্বার্থে কাজ করছেন, সরকারি সুবিধা ও ভাতা বণ্টনে পক্ষপাত দেখাচ্ছেন, এমনকি ভোটারদের ওপর চাপ প্রয়োগের ইঙ্গিতও দিচ্ছেন। এসব কারণে প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন পর্যবেক্ষকরা। নির্বাচনি আচরণবিধি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না হলে ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরাই হতে পারেন নির্বাচনের মাঠে সবচেয়ে বিতর্কিত ও প্রভাবশালী শক্তি।
স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী, চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে পরিষদের সিনিয়র সদস্য বা প্রশাসনিকভাবে নিয়োজিত কর্মকর্তা এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব প্যানেল চেয়ারম্যান বা প্রশাসক পদে থাকা ব্যক্তিরাও প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের ঘনিষ্ঠ বা তাদের মনোনীত ব্যক্তি। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তারা নির্বাচনি নিরপেক্ষতার বদলে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছেন। বিভিন্ন জেলায় অভিযোগ উঠেছে- কিছু প্রশাসক স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় নেতাদের ইঙ্গিতে কাজ করছেন, সরকারি প্রকল্প বণ্টন ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে রাজনৈতিক পক্ষপাত দেখাচ্ছেন। অন্যদিকে, কিছু জায়গায় নিরপেক্ষ প্রশাসকরা পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন, কারণ স্থানীয় রাজনীতির চাপ ও প্রভাব তাদের কার্যক্রমকে সীমিত করে ফেলছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইউপি চেয়ারম্যান সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন এবং স্থানীয় পরিষদের প্রশাসনিক, উন্নয়ন ও নাগরিক সেবাবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এসব ক্ষমতা ব্যবহার করে স্থানীয় স্তরে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গড়ে ওঠে, ফলে চেয়ারম্যানদের বাস্তব প্রভাবকে হালকা করে দেখার কোনো কারণ নেই। তাদের মতে, ইউপিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ভোটের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ইউপি জনপ্রতিনিধিরা গ্রামীণ ভোটধারা, এলাকাভিত্তিক শক্তিশালী ও পরিবারের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। নির্বাচনি সময় তারা ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক এবং স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে ভোট জমায়েত, প্ররোচনা বা সমর্থন সংগঠিত করতে পারেন। জনপ্রতিনিধিরা সরকারি ও সামাজিক নিরাপত্তা-বেনিফিট (বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, জন্ম/মৃত্যু সনদ ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রণে প্রভাবশালী। নির্বাচনের আগে এ ধরনের বিতরণ ‘ভোট-নেতৃত্ব’ হিসেবে কাজে লাগতে পারেন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্মসচিব (ইউনিয়ন পরিষদ অধিশাখা) মোহাম্মদ ফজলে আজিম বলেন, দেশে বর্তমানে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। তিনি জানান, প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও নতুন করে প্রশাসক বা প্যানেল চেয়ারম্যান নিয়োগ হচ্ছে। ফলে কেন্দ্রীয়ভাবে হালনাগাদ তথ্য রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে- ইউনিয়ন পরিষদগুলো চেয়ারম্যান, প্যানেল চেয়ারম্যান নাকি প্রশাসক দায়িত্বে আছেন- তার বিস্তারিত তালিকা প্রস্তুত করতে। সব ইউনিয়নের তথ্য সংগ্রহ করা হলে তখনই পরিষ্কারভাবে জানা যাবে বর্তমানে কতজন চেয়ারম্যান এখনো দায়িত্বে বহাল আছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী মনে করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ না নেওয়ায় মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে বিএনপিই সামনে আসবে। তার বিশ্লেষণে, জামায়াতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছুটা প্রভাব দেখাতে পারলেও জাতীয় পর্যায়ে তেমন শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারবে না। ফলে তারা বিরোধী শক্তি হিসেবে টিকে থাকবে।
তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান জনপ্রতিনিধিদের অনেকের রাজনৈতিক পরিচয় আওয়ামী লীগের হলেও, তাদের স্বার্থ এখন ক্ষমতার ধারাবাহিকতার সঙ্গে জড়িত। তাই তারা এমন পক্ষেই কাজ করবেন, যাদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই প্রেক্ষাপটে, অনেক ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য বিএনপি কিংবা তাদের জোটের প্রার্থীদের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অধ্যাপক নুরুল আমিন আরো বলেন, ‘যদি জাতীয় নির্বাচন সত্যিকারের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’ তার মতে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ না নিলে তাদের একটি বড় অংশের ভোট বিএনপি কিংবা জামায়াতের দিকে যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘অনেকে মনে করবেন যেহেতু আওয়ামী লীগ নেই, তাই এখন বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে মিলে কাজ করলে ভবিষ্যতে কিছু সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।’