‘ইচ্ছে তো অনেক। আপাতত যদি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে পারতাম।’ শনিবার রাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ। রোববার দুপুরেই তার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে! আজাদের জীবন কেড়ে নিয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খসে মাথায় পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান আজাদ। তার অস্বাভাবিক এই মৃত্যুতে চিরদিনের জন্য বাবাহারা হয়েছে দুই অবুঝ শিশু। অসহায় হয়ে পড়েছে একটি পরিবার। এই দুর্ঘটনায় থেমে গেছে শৈশবে বাবা-মা হারা আজাদের জীবনসংগ্রাম। গতকাল লাশ নিতে মর্গে এসেছিল আবুল কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া। সঙ্গে ছিল দুই শিশু সন্তান আব্দুল্লাহ (৫) ও সুরাইয়া আক্তার (৩)। আজাদের মরদেহের সামনে পিয়া ও শিশু সন্তানদের কান্না মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। এই কান্নার জবাবে তাদের সান্ত্ব্তনা দেয়ার ভাষা পাচ্ছিলেন না কেউ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনের কাছে এই দুর্ঘটনা ঘটে। মেট্রোর ভায়াডাক্ট ও পিয়ারের মাঝে বসানো বিয়ারিং প্যাডটি ছিটকে ফুটপাথে সোজা আজাদের মাথায় গিয়ে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। প্রায় দেড়শ’ কেজি ওজনের এই প্যাড রাবার ও ইস্পাতের তৈরি। নিহত আবুল কালাম আজাদ শরিয়তপুরের নড়িয়ার ইশ্বরকাঠি এলাকার বাসিন্দা। প্রবাসফেরত এই যুবক মতিঝিলে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করতেন। থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। কাজের উদ্দেশ্যে তিনি খামারবাড়ি এলাকায় ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন।
এই ঘটনায় সরকার নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণস্বরূপ ৫ লাখ টাকাসহ পরিবারে চাকরি করার মতো উপার্জনক্ষম ব্যক্তিতে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল মেট্রোরেলের ফার্মগেট স্টেশন পরিদর্শনে এসে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল করিম সরকারের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেন। দুর্ঘটনার পর কয়েক ঘণ্ট মেট্রো চলাচল বন্ধ ছিল। বিকালে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলাচল শুরু হয়। সন্ধ্যায় মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত পথে মেট্রো চলাচল করে।
তেজগাঁও থানার ওসি মোবারক হোসেন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনের নিচে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনের ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। এমন সময় উপর থেকে বেয়ারিং প্যাড তার উপরে পড়লে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। দুর্ঘটনাস্থলে ওই প্যাড আবুল কালামকে আঘাত করে ছিটকে পড়ে ফুটপাথে থাকা একটি চায়ের দোকানের সামনে। এতে দোকানটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আহত হন দোকানদারসহ দু’জন। ওই দোকানের চা খাওয়ার সময় আহত হয়েছেন মোহাম্মদ হেলাল। তিনি মানবজমিনকে বলেন, প্যাডটি আবুল কালামের গায়ে পড়ে। এতে সে পড়ে যায়। আমি তখন চা খাচ্ছিলাম এই দোকানে। তখন কাচের টুকরা এসে আমার দুই হাতে লাগে। আমাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাওয়ায় আমি পরের অবস্থা দেখতে পারিনি।
ওদিকে, মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফকে এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে। কমিটিতে কারিগরি ও প্রকৌশলগত পর্যালোচনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং সামরিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (এমআইএসটি)-এর বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটি’র সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাহিদুল ইসলাম এবং ডিএমটিসিএল’র লাইন-৫-এর প্রকল্প পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব। উপ-সচিব আসফিয়া সুলতানা কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। কমিটিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আগেও একবার খসে পড়েছিল মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড:
মেট্রোরেলের পিয়ার থেকে বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ার ঘটনা নতুন নয়। গত বছরও একবার এটি খসে পড়ে একদিন দীর্ঘ সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। ফার্মগেট ও বিজয় সরণির মাঝামাঝি এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। গত বছর ১৮ই সেপ্টেম্বর এই ঘটনা ঘটলে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ১১ ঘণ্টা মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ থাকে। মেট্রোরেলের উড়ালপথ নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ বিয়ারিং প্যাড। বিশেষ ধরনের রাবার দিয়ে তৈরি এ প্যাড বসাতে হয় পিয়ার ও ভায়াডাক্টের (উড়ালপথ) সংযোগস্থলে। উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল প্রকল্পেও এটি ব্যবহার করা হয়েছে। সেসময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই এটা বসানো হয়েছিল। কী কারণে খুলে পড়েছে তা অনুসন্ধান করে দেখা হবে। পরে এ বিষয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করে সরকার। এরও আগে ২০২০ সালে বুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষা চালিয়ে উত্তরা-আগারগাঁও অংশের দু’টি প্যাকেজের জন্য আমদানি করা বিয়ারিং প্যাডের মান খারাপ হিসেবে চিহ্নিত করে। এসব বিয়ারিং প্যাড সরবরাহ করেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, গতকাল ঘটা মেট্রোরেল দুর্ঘটনার কমিটি সেপ্টেম্বরে ঘটা দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধকল্পে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা প্রস্তুত এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করাও কমিটির কাজের অন্তর্ভুক্ত। ডিএমটিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, ফার্মগেটের খেজুর বাগান মোড়ে নির্মাণ নকশায় ত্রুটি ছিল। এর আগেও এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে, জাপানিজ ঠিকাদারদের ঠিক করতে বলা হলেও করেনি।
আমার বাচ্চাদের কী হবে?
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে লাশ নিতে এসেছিলেন আবুল কালাম আজাদের পরিবারের লোকজন। আজাদের স্ত্রী পিয়ার সঙ্গে ছিল তার দুই শিশু সন্তান। মায়ের কোলে থাকা শিশু আবদুল্লাহর কান্নায় ভারী হয়ে উঠছিল চারপাশ। বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন পিয়া। কথা বলতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, আজকে তাকে আমি বিদায় দিতে চাইনি। দরজা লাগাতেও যাইনি...আমার বাচ্চাদের কী হবে? বারবার তিনি বলছিলেন, আমার বাচ্চাদের কী হবে?
সংগ্রামের জীবন ছিল আজাদের। ছোটবেলাতেই বাবা-মাকে হারান। ১০ ভাইবোনের সবার ছোট আবুল কালাম। বড় হয়েছে ভাই-বোনদের সংসারে। অনেক কষ্টে করে লেখাপড়া করেন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। গিয়েছিলেন প্রবাসেও। দেশে তিনি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরিবার নিয়ে থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। ব্যবসার কাজে প্রায় প্রতিদিন আসতেন মতিঝিলে আর মাঝে মধ্যে আসতেন ফার্মগেটে।
আজাদের ভাবী আছমা বেগম বলেন, মৃত্যুর প্রায় ৩০ মিনিট আগে কথা হয় তাদের। সে বলছিল, দু-এক দিনের মধ্যে বাড়িতে আসবে, আর আমাকে ইলিশ মাছ কিনে রাখতে বলেছিল। আমার ভাই আর আসলো না।
শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে ২০১২ সালে কাজ করতে যান মালয়েশিয়াতে। সেখান থেকে ফিরে ২০১৮ সালে পাশের গ্রামের আইরিন আক্তারকে বিয়ে করেন। স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান নিয়ে আবুল কালাম নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলি এলাকায় বসবাস করতেন। তার মৃত্যুতে শোকাহত ঈশ্বরকাটি গ্রামের বাসিন্দারা। কান্নায় ভেঙে পড়েন গ্রামে থাকা তার স্বজনরা। তার এমন অকাল মৃত্যু মানতে পারছে না কেউ।
সরজমিন বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চার ভাইয়ের চারটি টিনশেডের বসতঘর রয়েছে। আজাদের ঘরটি তালাবদ্ধ। তার বড় ভাই খোকন চোকদারের ঘরে বসে কান্না করছিলেন বড় বোন সেলিনা বেগম, কাঁদছিলেন পরিবারের অন্য সদস্যরাও। তার মৃত্যুর খবর শুনে গ্রামের মানুষেরা ও এলাকার তার বন্ধু-বান্ধবেরা বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন। আবুল কালামের বাল্যকালের বন্ধু রিহিনুজ্জামান মানবজমিনকে জানান, একমাস আগে যখন গ্রামে এসেছিল তখন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমার সেই হাস্যোজ্জ্বল বন্ধুটি আজ নেই ভাবতে পারছি না। তার মৃত্যুটি হয়েছে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার কারণে। এমন মৃত্যুর দায় আমরা কার ওপরে চাপাবো?
ঘরে বসে আবুল কালামের ছবি হাতে নিয়ে কান্না করছিলেন বড় বোন সেলিনা বেগম। কান্না করতে তিনি বলছিলেন, আমার ভাইটি সারাজীবন কষ্ট করেছে। কিশোর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছে। আজ দুই শিশু সন্তান রেখে সে নিজেও না ফেরার দেশে চলে গেছে। এখন এই শিশু দুইটির কী অবস্থা হবে? কে তাদের পিতৃস্নেহ দেবে। তার বিধবা স্ত্রী কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে? পরিবারসূত্রে জানা যায়, সোমবার সকাল সাড়ে আটটায় নিজ বাড়িতে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।