
জুলাই বিপ্লবে মৌলভীবাজারে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলার আসামিরা একে একে হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মামলায় ৫৭০ জন জামিন পেয়েছেন। ছাড়া পেয়ে তারা নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। এতে জেলার আইনশৃঙ্খলা অবনতির আশঙ্কায় জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্র জানায়, চব্বিশের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে এ জেলায় এক হাজার ১৭৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক আসামি জামিনে আছেন। অনেকের জামিনের বিষয় প্রক্রিয়াধীন। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন ।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন হামলায় এ জেলার সম্প্রতি বিচারপতি বিস্ময় দেব চক্রবর্তী ও একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে ১০৬ জন, বিচারপতি জেবিএম হাসান ও ফয়েজ আহমদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে ২৩, বিচারপতি মো. ইকবাল কবির ও রিয়াজ উদ্দিন খান সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে ৩০, বিচারপতি জাকির হোসেন ও সৈয়দ জাহেদ মনসুরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে ২৫, বিচারপতি সাইফুর রহমান ও বিচারপতি সওকত আলী চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে ১৩১, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে ২৫, বিচারপতি এসএম আব্দুল মবিন ও বিচারপতি কেএম রাশিদুজ্জামান রাজার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে ২১ এবং বিচারপতি খায়রুল আলম ও বিচারপতি কেএম ইমরুল কায়েসের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে ৩১ ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহ ও তৌফিক ইনাম সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে ৫৭ জনকে জামিন দেওয়া হয়েছে।
এরা সবাই মৌলভীবাজারে আওয়ামী লীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও বিভিন্ন হামলার ঘটনার অভিযোগে করা মামলার আসামি বলে জানা গেছে।
পুলিশের তালিকা অনুযায়ী জামিনে ছাড়া পাওয়া উল্লেখযোগ্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন-মৌলভীবাজার শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা আনিসুল হক চৌধুরী তুষার। তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট সরাসরি আন্দোলন দমাতে গুলি করে। তার জামিনে জেলা শহরে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কুলাউড়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসারের ভাই ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম, কুলাউড়া উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যান আজাদ আহমদ, ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুব আহমদ, ৪ নম্বর জয়চন্ডী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আব্দুর রব মাহবুব, হাজীপুর ইউনিয়ন যুবলীগের বন পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক গুলজার আহমেদ, কুলাউড়া উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান বক্স। সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের ভাগিনা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বড়লেখা সালেহ আহমদ জুয়েল, উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি জালাল আহমদ।
এছাড়া আওয়ামী লীগের মৌলভীবাজার-৩ আসনের সাবেক এমপি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের ছোট ভাই ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান, জেলা সদর উপজেলার কনকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রুবেল আহমদ, কামালপুর ইউনিয়ন যুবলীগের প্রচার সম্পাদক দিপন আহমেদ, ১১ নম্বর মোস্তফাপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আজাদুর রহমান মেম্বার, শ্রীমঙ্গল উপজেলার আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আছকির মিয়া, শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মো. ইউছুফ আলী, শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ভুনবীর ইউনিয়নের মেম্বার আব্দুল ওয়াহিদ হাওর মিয়া, ভুনবীর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জসিম আহমেদ কামাল, কালীঘাট ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রিপন মৃধা, ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৫ নম্বর ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুস সালাম, শ্রীমঙ্গল উপজেলা যুবলীগের সদস্য আকরামুল হক সোহাগ ও জুড়ী উপজেলার জায়ফর নগর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি আজিজুল ইসলাম মাসুক, ২ নম্বর পূর্ব জুড়ী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি মো. আসলাম উদ্দিন, পূর্ব জুড়ী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সালেহ উদ্দিন আহমেদ, পূর্ব জুড়ী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা রয়েল উদ্দিন, ফুলতলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল আলীম সেলু প্রমুখ।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ সুপার এমকেএইচ জাহাঙ্গীর হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনসহ বিগত সময়ের ভুক্তভোগী যারা মামলা করেছে সেই মামলায় যারা আটক আসামি আছে তারা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আসলে তাদের নামে অন্য কোনো মামলা না থাকায় পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের নতুন কোনো মামলায় আটক রাখা বা গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, জামিনের বিষয়টা সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার। হাইকোর্ট থেকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জামিনের ব্যবস্থা করেন। আদালত থেকে যে অন্তর্বর্তী জামিনটা নিয়ে আসছেন এবং জেলার নিম্ন আদালতে দিচ্ছেন সেক্ষেত্রে আমাদের এখানে যারা সংশ্লিষ্ট সরকারি কৌঁসুলি আছেন তাদেরও আরেকটু ভালোভাবে বিষয়টি দেখা দরকার। তাহলে হয়তো দেখা যাচ্ছে যারা সাধারণ মানুষের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা বিভিন্ন জায়গায় ভয়ভীতি দেখাচ্ছে সেখান থেকে আমাদের কাছে মেসেজ আসছে। যদি তাদের নিম্ন আদালতে আটকে রাখা যায়, তারা বন্দি থাকা অবস্থায় যদি বিচার কাজ শুরু করা যায় তাহলে আমার মনে হয় আইনশৃঙ্খলার উন্নতির জন্য সহায়ক হবে।
এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজার জেলা জজ কোর্টের পিপি অ্যাডভোকেট ড. আব্দুল মতিন চৌধুরী বলেন, মামলাগুলা হাইকোর্ট থেকে জামিন হচ্ছে। আমার জজ কোর্ট থেকে তো এই এক বছরের মধ্যে একটাও জামিন হয়নি। আমি রিটেইন দিতে পারব। কিন্তু হাইকোর্ট থেকে জামিন হলে পরে এই যে ছয় মাসের জামিন দেয় কাউকে চার্জশিট পর্যন্ত বেইল দেয়। এসব মামলায় তো একটাও চার্জশিট হয়নি। আর ছয় বা এক বছরের বেইল দেয় এর পর আবার হাইকোর্ট থেকে জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে আনে। বাড়িয়ে আনায় নিচের কোর্টের কোনো ক্ষমতা আর থাকে না।