Image description

জুলাই বিপ্লবে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর তার দল আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) বহু নেতা-কর্মীকে আইনের আওতায় আনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এরমধ্যে দলটির মন্ত্রী থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীও রয়েছেন। কিন্তু যে গতিতে তাদের ধরা হচ্ছে ঠিক একই গতিতে তাদের দেওয়া হচ্ছে জামিন। পুলিশ বলছে, আওয়ামী আসামিরা যদি এভাবে জামিন পেতেই থাকে তাহলে আগামী নির্বাচন আয়োজন কঠিন হয়ে যাবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১০ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ৪৩ হাজার ৩০২ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য, কেন্দ্রীয় ও জেলা, উপজেলা, থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। মূলত তাদের ৪টি কারণে গ্রেপ্তার করা হয়। সেগুলো হচ্ছে— জুলাই বিপ্লবে ছাত্র জনতার ওপর হামলার মামলা, বিপ্লবের পর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ঝটিকা মিছিল করে লিফলেট বিতরণ এবং পুরনো মামলা। ঠিক একই সময়ে ৩১ হাজার ২৭২ জন জামিন নিয়েছেন। জামিনের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে—অসুস্থ, বয়স্ক ও দলীয় পদে না থাকা।

জামিনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আসামিদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত তথ্য উপস্থাপন করতে পারছে না পুলিশ। এ ছাড়া কিছু সুবিধাবাদী আইনজীবী অর্থ নিয়ে এই আসামিদের জামিনে সহযোগিতা করছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত ১ বছরে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বিভিন্ন মামলায় ২ হাজার ৮১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন ২ হাজার ২১২ জন। ঢাকা রেঞ্জে গত ১ বছরে গ্রেপ্তার হয়েছে ৬ হাজার ৯২৩ জন আর জামিন পেয়েছেন ৪ হাজার ৬১২ জন। রাজশাহী রেঞ্জে গ্রেপ্তার হয়েছে ৪ হাজার ৯৩৩ জন আর জামিন পেয়েছে ৩ হাজার ৯৯৮ জন। খুলনা রেঞ্জে গত ১ বছরে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫ হাজার ৯০১ জন আর জামিন পেয়েছেন ৪ হাজার ৬১২ জন।

বরিশাল রেঞ্জে গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ৫১২ জন আর জামিন পেয়েছেন ১ হাজার ৪৩৩ জন। রংপুর রেঞ্জে গ্রেপ্তার হয়েছে ৩ হাজার ৫৯১ আর জামিন ২ হাজার ৪১৪ জন। ময়মনসিংহে গ্রেপ্তার হন ২ হাজার ৯৬৬ জন। জামিন পেয়েছে ১ হাজার ৩৪৩ জন। চট্টগ্রাম রেঞ্জে গত ১ বছরে গ্রেপ্তার হয়েছে ৭ হাজার ৫২৩ জন আর জামিন পেয়েছে ৫ হাজার ৮১৩ জন। আর সিলেট রেঞ্জে গত ১ বছরে গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ২৯৮ জন। এদের মধ্যে জামিন পেয়েছে ৯৮০ জন।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের অনেকেই ফৌজদারী মামলার আসামি। অনেকের বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লবে হত্যা, গুলি ছোঁড়া, হামলা, পুলিশের সঙ্গে মিলে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার মামলা রয়েছে। এসব মামলা খুবই গুরুতর। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতা-কর্মী। এরাই মূলত গত ১৫ বছরে বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। তারা এভাবে জামিনে মুক্ত হলে আবারও সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। বেড়ে যাবে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল ও রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফ্যাসীবাদের দোসররা গণহারে জামিন পেলে আগামী সংসদ নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে। এতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেকায়দায় পড়বে পুলিশ।

একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের বিরুদ্ধে যেমন মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তেমনই সুবিধাবাদী কিছু আইনজীবী জামিন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। তারা অর্থের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের দোসরদের জামিনে সহযোগিতা করছেন। যারা জামিনে বের হয়ে আসছেন তারা আবার ওইসব আইনজীবীর কাছে অন্য আসামির স্বজনদের পাঠাচ্ছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, এখন জামিনের হার শূন্য। তবে যাদের কোনো দলীয় পদ নেই; অসুস্থ, বয়স্ক তারা কিছুটা জামিন পাচ্ছেন। এই শ্রেণীর যারা জামিন পাচ্ছেন তাদের বন্দিত্ব প্রায় ১ বছর হয়ে গেছে।

অপরাধীদের এভাবে জামিনে বের হওয়া সমাজের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হবে— সে বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সমাজ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট বিভাজন এবং পরাজিত ফ্যাসিবাদ নানাভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। জুলাই বিপ্লবে জনবিরুদ্ধ কাজের অভিযোগে যেসব অভিযুক্তরা কারাগারে আছে তাদের অভিযোগ যথাযথভাবে তদন্ত করে জামিনসহ অন্যান্য আইনি অধিকার বিবেচনা করা প্রয়োজন।

পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আসামিরা জামিন কেন পাচ্ছেন তার কারণ বলতে পারবে আদালত। তবে পুলিশের কোনো দুর্বলতা রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আইজিপি বাহারুল আলম গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় আমার দেশকে বলেন, আদালত থেকে ফ্যাসিস্টরা কেন জামিন পাচ্ছে সেই বিষয়টি আমরা এনালাইসিস করব। আগামীতে জাতীয় নির্বাচন হবে। এরা বের হয়ে এলে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে।