Image description
 

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রে এখন ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। এ সনদ কবে বাস্তবায়ন হবে, কী প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হবে এবং কীভাবে এর আইনি ভিত্তি তৈরি হবে—এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে মতভিন্নতা। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের মতামত নিতে এরই মধ্যে সামনে এসেছে ‘গণভোট’ প্রসঙ্গটি। সেই গণভোট কবে হবে, তা নিয়ে এখনো সুরাহায় পৌঁছাতে পারেনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কোনো কোনো দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে পৃথক ব্যালটে গণভোটের প্রস্তাব করছে, আবার কোনো কোনো দলের দাবি- আগামী নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে।

এমন বাস্তবতায় জুলাই সনদ স্বাক্ষরের জন্য শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) দিন ঠিক করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক মতভিন্নতা থাকায় এখানেও উঁকি দিচ্ছে অনিশ্চয়তা। শেষ পর্যন্ত কোন কোন দল সনদে সই করবে, কারা করবে না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি।

 

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে মতামত দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরাও। সনদ সংবিধানে যুক্ত করতে হলে রাজনৈতিক সরকার তথা নির্বাচিত সংসদ প্রয়োজন। সংসদ ছাড়া সংবিধানে কোনো অনুচ্ছেদ বা প্রসঙ্গ যুক্ত করার বিধান নেই। জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে একাধিক আইনজীবীর কথায় এমনটিই উঠে এসেছে।

তারা মনে করছেন, অতীতের বিতর্কিত ও জনবিরোধী বিষয়গুলো যেন আর ফিরে না আসে, জুলাই সনদের মাধ্যমে তার নিশ্চয়তা আদায় করে নিতে হবে। এজন্য দরকার জাতীয় ঐকমত্য, এর ভিত্তিতে সনদের বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ।

  

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন জাগো নিউজিকে বলেন, ‘ইংল্যান্ডের সিটিজেন চার্টার বা ম্যাগনাকার্টা সনদ, যেগুলো সংবিধানের মাধ্যমে বা কোনো ল’ ডিক্রির মাধ্যমে হয়নি। বাংলাদেশে গত দেড় দশক গণতন্ত্র ছিল না, আইনের শাসন ছিল না, মানবাধিকার ছিল না, গুম-হত্যা চলছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান থেকে বোঝা যায় যে জনগণ একটা পরিবর্তন চায়। শুধু আমরা না, সরকারের ভেতর থেকেও চাচ্ছিল যে একটা পরিবর্তন হোক।’

তিনি বলেন, ‘এখন তো সংসদ নেই, নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই, হয়তো রাজনৈতিক দলগুলো বসে একটা সমঝোতা করবে। এখানে মানবাধিকার, আইনের শাসন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রয়োজন। দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। সংসদে গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র চলবে না। সব পরিস্থিতিতে রোল অব ল’ থাকতে হবে।’

 

‘ব্যুরোক্রেসি বা আমলাতন্ত্র- যেখানে আমাদের নিউট্রাল থাকতে হবে। যারা অপরাধ করেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন, যারা গুম-খুন করেছেন তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবী আরও বলেন, ‘জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো সই করবে। এটি পাবলিকলি একটি চুক্তি। সেটি বাস্তবায়ন করবে জনগণ। ভোট দিয়ে মতামতও জানাবে জনগণ। এরপর যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাবে বা সরকার গঠন করবে সনদ বাস্তবায়ন তাদেরই দায়িত্ব। যারা বিরোধী দলে থাকবেন তাদের দায়িত্ব হবে সরকারকে সহযোগিতা করা।’

অতীতের বিতর্কিত ও জনবিরোধী বিষয়গুলো যেন আর ফিরে না আসে, জুলাই সনদের মাধ্যমে তার নিশ্চয়তা আদায় করে নিতে হবে। এজন্য দরকার জাতীয় ঐকমত্য, এর ভিত্তিতে সনদের বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ।—বলছেন আইনজীবীরা

‘তবে জুলাই সনদকে কীভাবে সংবিধানে যুক্ত করা হবে আমার কাছে তা বোধগম্য নয়’- যোগ করেন খোকন।

 

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব জাগো নিউজিকে বলেন, ‘জুলাই সনদ জন্ম থেকেই বাতিল। কারণ, এ সরকার সংবিধানকে রক্ষা ও সংরক্ষণ করবে মর্মে শপথ নিয়েছে। সুতরাং নির্বাচিত সংসদ ছাড়া সংবিধানে হাত দেওয়া যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘সংবিধানের আর্টিকেল ৯৩-তে অর্ডিন্যান্সের এখতিয়ার দেওয়া আছে। তবে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ সদস্যদের অনুপস্থিতিতে সেরকম কোনো অর্ডিন্যান্সও করতে পারবে না। এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

মামুন মাহবুব বলেন, ‘জুলাই সনদ কিংবা প্রোক্লেমেশন হতো—যদি ড. ইউনূস সাহেবরা আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ না নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শপথ নিয়ে বলতেন—জনগণের আন্দোলনের অভিপ্রায় হিসেবে আমরা শপথ নিলাম। তখন সংবিধান স্থগিত হয়ে যেতো, জুলাই ঘোষণাপত্র দু-তিন দিনের মধ্যে প্রস্তুত করা হতো। এরপর খসড়া তৈরি করে বলা যেতো—দেশ এই এই প্রক্রিয়াই চলবে। তখন সেটা ঠিক ছিল। এখন কোন প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ সই বা বাস্তবায়ন হবে?’

 

জুলাই সনদ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম. আশরাফুল ইসলাম জাগো নিউজিকে বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা সংসদের মাধ্যমে যখন টু-থার্ড মেজরিটি নিয়ে এই বিল পাস করবেন তখন জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি তৈরি হবে। সেটাই হচ্ছে জেনুইন ও পারফ্যাক্ট। অন্যভাবে যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে চায় সেটি হতে পারে গণভোটের মাধ্যমে। যদি গণভোটের মাধ্যমে পাস করা যায় তাহলে এটির আইনগত ভিত্তি থাকবে।’

জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন মত থাকা স্বাভাবিক। বিএনপি যেমন জনসম্পৃক্ত, জামায়াতও তা-ই। কিন্তু অন্য দলগুলোকে যদি কাউন্ট করেন তাদের সঙ্গে কিন্তু জনগণের সম্পৃক্ততা খুব কম আছে। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, জনগণ কোনো রাজনৈতিক দলকে ম্যান্ডেট দেয়নি যে তারা যা করবে সেটাই আইন। আইন পাস হবে সংসদে, এটাই আইন। সংসদে ডেলিগেটেড রেজুলেশনের মাধ্যমে আইন পাস করতে হবে। কিন্তু জুলাই সনদ কোনো ডেলিগেটেড রেজুলেশন নয়।’

তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ হওয়ার কথা ছিল ৫ আগস্টের পর। কিন্তু আমরা তখন যেটা লক্ষ্য করেছি—যারা স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে তারা দেখেছে জুলাই সনদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংবিধানকে বারবার কবর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি সংবিধানকে অপমানিত অপদস্ত করা হয়েছে। এতে অনেকে আহত হয়েছেন। সংবিধান যদি ফ্যাস্টিস হয় মনে করেন তাহলে রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কিছু করা যাবে না। কেউ যদি রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কিছু করেন সেটার দায় তাকেই নিতে হবে। যদি সংবিধানের অধীনে শপথ মেনে কিছু করা হয় তাতে সংবিধান ফ্যাসিস্ট হয় না।’

 

সংসদ সদস্যরা সংসদের মাধ্যমে যখন টু-থার্ড মেজরিটি নিয়ে এই বিল পাস করবেন তখন জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি তৈরি হবে। সেটাই হচ্ছে জেনুইন ও পারফ্যাক্ট। অন্যভাবে যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে চায় সেটি হতে পারে গণভোটের মাধ্যমে।—ব্যারিস্টার এম. আশরাফুল ইসলাম

জুলাই সনদ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান বলেন, ‘জুলাই সনদটি এমন একটি বিষয় যেটি সারাদেশের বিল্পবী জুলাইযোদ্ধাদের অন্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যদিও এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে সই করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দল কোনো বিষয়ে একমত হলেও তা আইনে পরিণত হয় না। জুলাই সনদের স্পিরিটের ভিত্তিতে কার্যক্রম করার জন্য অবশ্যই সেটি আইনে পরিণত করতে হবে। সেটি আইনে পরিণত করার দুটি প্রক্রিয়া আছে। তা হলো—জুলাই সনদকে গেজেট নোটিফিকেশন করা এবং গেজেটের আলোকে নির্বাচন কমিশন বা অন্য যে কেউ কার্যক্রম করতে পারবে।’

গণভোট বিষয়ে সাইফুর রহমান বলেন, ‘পিআর পদ্ধতির ভোট হবে কি না সেটি নিয়ে গণভোট হতে পারে। কিন্তু জুলাই সনদ হবে কি না সেটি নিয়ে কোনো গণভোট প্রয়োজন নেই। কারণ, জুলাই সনদকে আইনে পরিণত করার জন্য রাষ্ট্রপতি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে করতে পারবে। সেখানে গণভোট প্রয়োজন নেই।’

 

ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি হচ্ছে। জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত অনুলিপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) ঐতিহাসিক মুহূর্তে সবার উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সনদ সই অনুষ্ঠান হবে। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এ সনদ সই অনুষ্ঠিত হবে।

গত মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাতে সনদের চূড়ান্ত অনুলিপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে এখনো ঐকমত্য হয়নি।

এই সনদ সই করার মধ্য দিয়ে তা ‘নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল’ হিসেবে পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করবে দলগুলো। প্রধান উপদেষ্টা, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ও সদস্যরা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দুজন করে প্রতিনিধি এ সনদে সই করবেন। ৩০টি দল ইতোমধ্যে দুজন করে স্বাক্ষরকারীর নাম কমিশনের কাছে পাঠিয়েছে।

গত মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাতে দলগুলোর কাছে সনদের অনুলিপি পাঠানো হয়। তবে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কমিশনের সুপারিশ দেওয়া হয়নি। সনদ সই হওয়ার পর বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে নিজেদের সুপারিশ সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে দেবে কমিশন।

অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ না নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শপথ নিয়ে বলতেন—জনগণের আন্দোলনের অভিপ্রায় হিসেবে আমরা শপথ নিলাম। তখন সংবিধান স্থগিত হয়ে যেতো, জুলাই ঘোষণাপত্র দু-তিন দিনের মধ্যে প্রস্তুত করা হতো। এরপর খসড়া তৈরি করে বলা যেতো—দেশ এই এই প্রক্রিয়াই চলবে। তখন সেটা ঠিক ছিল। এখন কোন প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ সই বা বাস্তবায়ন হবে?—আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব

এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর দলগুলোকে সনদের যে খসড়া দেওয়া হয়েছিল, সেটিই চূড়ান্ত করে মঙ্গলবার দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত সনদে মূল বিষয়বস্তুতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

শুধু কয়েকটি ক্ষেত্রে শব্দগত সংশোধন আছে। জুলাই জাতীয় সনদের তিনটি ভাগ আছে। প্রথম ভাগে আছে সনদের পটভূমি, দ্বিতীয় ভাগে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এবং তৃতীয় ভাগে আছে সনদ বাস্তবায়নের ৭ দফা অঙ্গীকারনামা।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশন (সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন)। এসব কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে ৩৩টি ও দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐক্য কমিশন।

তবে সব দল শেষ পর্যন্ত সনদে সই করবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয় বলে জানা গেছে। সনদ বাস্তবায়নে গণভোট করার বিষয়ে একমত হলেও ভোটের দিন ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা রয়েই গেছে। কোনো কোনো দল সনদে সই করার আগে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে নিশ্চয়তা চাইছে।