Image description

রোম শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশিরা আছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘রোম শহরের কোনো রেস্টুরেন্ট নেই, যেখানে বাংলাদেশি শেফ নেই। বাংলাদেশি শেফ চলে গেলে, রোম শহর অচল হয়ে যাবে।’

রোমের একটি নামকরা রেস্টুরেন্টে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, রেস্টুরেন্টের মালিক নিজে এসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জানান যে, "আসলে রেস্টুরেন্ট তারাই চালায়... এদের কারণেই আমার উপার্জন"

 

শুধু ইতালি নয়, ড. ইউনূস মস্কোর একটি সেরা ইতালীয় রেস্টুরেন্টের অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেন, যেখানে তিনি দেখেছেন বাংলাদেশি শেফরাই রান্নাঘর পরিচালনা করছেন এবং ইতালীয় খাবার তৈরি করছেন। তিনি মন্তব্য করেন, এখন "বাংলাদেশি শেফ না হলে বেস্ট রেস্টুরেন্ট হচ্ছে না"

অবৈধ পথে আসা একজন বাংলাদেশিকে ফেরত নেওয়া হলে, বিনিময়ে অপর একজন বাংলাদেশিকে নিয়মিত পথে আসার আসার সুযোগ দেবে ইতালি। ইউরোপের দেশটি বাংলাদেশকে এমন প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

 

এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাটি চলমান রয়েছে বলেও জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার ইতালির রাজধানী রোমের একটি হোটেলে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।

এর আগের দিন সোমবার ইতালির রাজধানী রোমের মেয়র রবার্তো গুয়ালতিয়েরির সঙ্গে তার কার্যালয়ে দেখা করেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।

 

সেই সাক্ষাত প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রোমের মেয়র ‘অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বলেছেন যে আপনারা খুব মূল্যবান তার জন্য। এই শহরের একটা মূল্যবান অংশ আপনারা কন্ট্রিবিউট করছেন এবং আপনাদের কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে রোম শহরের যে উন্নতি হচ্ছে সেটা বারে বারে উনি উল্লেখ করেছেন। আপনাদের পরিশ্রম, আপনাদের মেধা, আপনাদের সৃজনশীলতা—এগুলোর খুব প্রশংসা করেছেন।

ইতালিতে বসবাসতরত বাংলাদেশিদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে অবগত জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সেসব বিষয় নিয়ে রোমের মেয়রের সঙ্গে কথা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ভিসার কথা বললাম। এই যে লোক বের করে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বললাম। যাদের ভিসা দেওয়া হয়েছিল, এখন ভিসা রিনিউ করা হচ্ছে না, সেগুলোর কথা বললাম।’

জবাবে ইতালির রাজধানী রোমের মেয়র কী উত্তর দিয়েছেন, তা নিয়েও প্রবাসীদের সামনে কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘(মেয়র বলেছেন) বাংলাদেশি যারা আছেন, তারা ইতালির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা এমন না যে আমরা তাদের থেকে নিষ্কৃতি পেলে বাঁচি। আমরা তাদের রাখতে চাই, এটা পরিষ্কার। সম্মানের সঙ্গে রাখতে চাই।’

কিন্তু এতে কিছু সমস্যা আছে বলেও প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন রোমের মেয়র রবার্তো গুয়ালতিয়েরি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ভেজাল, এই বাংলাদেশ যেখানে যাচ্ছে ভেজালের একটা সৃষ্টি করছে। এটা থেকে আমরা বাঁচতে পারছি না। এটা থেকে নিষ্কৃতি কীভাবে? আমি বললাম যে আমরা দুই পক্ষ চেষ্টা করি, আমাদেরও কষ্ট হয়। তারাও (বাংলাদেশি অভিবাসী) কষ্ট পায়, আমরাও কষ্ট পাই। তারা (বাংলাদেশি অভিবাসী) ঠেকায় পড়ে এসবের মধ্যে পড়ে গেছে, এমন না যে তারা আসলে দুষ্ট লোক। তারা ভালো লোক, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে দুষ্টুমি করে টিকে থাকতে হচ্ছে তাদের। দুষ্টুমি করে যাতে টিকতে না হয় সে জন্য একটা পন্থা বের করতে হবে আমাদের।’

সমাধান হিসাবে ইতালির পক্ষ থেকে অধ্যাপক ইউনূসকে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এখন বলছে যে, একজন যদি নিয়ে যাও, আমরা একজন নতুন আনবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘একজন ভেজাল লোক… অদলবদল করে জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে যাক। অর্থাৎ জিনিসটা পরিষ্কার। তাদেরও ইচ্ছা পরিষ্কার, আমরাও চাই যে পরিষ্কার। এখন একজনের পরিবর্তে একজন হবে, না কি একজনের পরিবর্তে দুই জন হবে, এগুলো নিয়ে আমরা একটু আলাপ করছি যে কী করা যায়। এটা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হবে, উপায় নেই আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে তাদের এটা করতে হয়।’

ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত দেশটিতে অনিয়মিত পথে আসা আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ৫৪ হাজার ৩৮০। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৬ হাজার ১৭৫ জন হলেন বাংলাদেশি নাগরিক৷ দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মিশরীয়দের সংখ্যা সাত হাজার ৪৫৯। এর পরেই রয়েছে ইরিত্রিয়া, পাকিস্তান ও সুদানের নাম।

অনিয়মিত পথে আসা বাংলাদেশিদের প্রসঙ্গ ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই যে নানাভাবে আসেন, তাদের সঙ্গেও আমার আলাপ হয়েছে। জাহাজ থেকে সদ্য নামা লোকের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। মেয়রকে নিয়েও আলাপ হয়েছে। কী করবে এখন, এরা তো এসে গেছেন। মেয়র বললেন যে ঠিক আছে। এসে যখন গেছে, আমাদের দায়িত্ব হলো তাদের গ্রহণ করা। তাদের এখানে সেটেল করা। তাদের (ইতালির) অ্যাটিটিউড দেখলাম যে এরকম না, এক্ষুণি জাহাজে উঠো, ফেরত যাও। ওরকম বলেনি। ওরকম বলে না তাদের। এটাই ভালো লাগে যে, এরা সম্মান করে, মানবিকতা আছে।’

কিন্তু বাংলাদেশিরা ইতালিতে এসে থাকতে চান না বলেও প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন ইতালির মেয়র রবার্তো গুয়ালতিয়েরি। এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘মেয়র বললেন, এরা এখানে থাকবে না তো। আমি বললাম, কেন? বললেন, তাদের ডেসটিনেশন হলো অন্য দিকে। আরো উত্তরে যাবে। উত্তরে যেতে যেতে কদ্দুর যাবে, সেটা তারাই জানেন। কিন্তু এখানে বেশিদিন থাকেন না।’

সমস্যা সমাধানে আলাপ চলমান রয়েছে জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘একটা তো হলো ভেজাল লোক, ঢুকে গেছে কাগজপত্র কিছু নেই। ভেজালের মধ্যে আছে। ওদের কীভাবে সঠিক পথে নিয়ে আসা যায়। অর্থাৎ চেষ্টা হচ্ছে সমাধান করা। তাড়িয়ে দেওয়াটা সমাধান না। এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। দুইপক্ষেই এটা পরিষ্কার, তাড়িয়ে দেওয়াটা সমাধান না।’

ইতালির ডানপন্থি প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনির সঙ্গে কয়েক দফা সাক্ষাৎ হওয়ার কথাও জানান মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘তিন বার দেখা হয়েছে। চতুর্থ বার আবার দেখা হবে ডিসেম্বরে। উনি বাংলাদেশে আসবেন তখন। কয়েকদিন আগেই দেখা হয়েছে। সেটা হলো নিউইয়র্কে।’

মানবপাচার ঠেকাতে সরকারের তৎপরতা প্রসঙ্গে কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘হিউম্যান ট্রাফিকিং যে জিনিসটা বলে, আপনারা সবাই পরিচিত আছেন, মস্ত বড় জিনিস, বহুলোক প্রাণ দেয় ইত্যাদি। এগুলো যেন দিতে না হয় সেটার চেষ্টা করা। যেহেতু তাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এটা বহুবার বুঝিয়েছি যে জিনিসটা যেন হয়, সুন্দরভাবে হয় এবং আপনারা যেন বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত হন।’

এ সময় প্রবাসীদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘অভ্যুত্থানের সময় আমরা যে সরকার পেলাম, যে অবস্থা পেলাম—এটা লন্ডভন্ড অবস্থা। টাকা-পয়সা সব খালি। চলাফেরা, বেতন দেবার উপায় নেই৷ মানুষের টাকা পরিশোধ করার উপায় নেই। আন্তর্জাতিক (ঋণ) পরিশোধ করার উপায় নেই। একদম তলানিতে আমরা।’

তখন রেমিট্যান্সের ওপরই আস্থা রেখেছিলেন বলে জানান মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘এই রেমিট্যান্স না হলে এই সরকার টিকে থাকা বড় মুশকিল হতো।’

ইতালির রোমে দুই দিনের সফর শেষে দেশে ফিরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার সকাল ৮টা ২০ মিনিটে তাকে বহনকারী বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইটটি রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত বার্ষিক ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামে অংশ নিতে গত রোববার (১২ অক্টোবর) স্থানীয় সময় বিকেল ৫টার দিকে ইটালির রাজধারী রোমে পৌঁছান অধ্যাপক ইউনূস। সূত্র: টাইম টিভি, জাগোনিউজ২৪