
সাম্প্রতিক সময়ে খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একটি রহস্যময় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। সেলুনে সেলুনে নাকি ঘোরাফেরা করছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (জঅড) এর এজেন্টরা। অনেকেই বলছেন, এসব এজেন্ট সাধারণ খদ্দেরের ছদ্মবেশে সেলুনে আসে, চুপচাপ বসে থাকে, কেউ কেউ পত্রিকা পড়ে, আবার কেউ কোনো চুল কাটায় না, শুধু বসে থেকে চলে যায়। রাতের আঁধারে এসব চলাফেরা দেখে কৌতূহলী হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। প্রশ্ন উঠছে, এটা কি নিছক গুজব, না এর পেছনে রয়েছে কোনো গোপন অপারেশনের ছায়া?
গুজবের উৎস কোথায়?
এ ধরনের কথাবার্তার শুরু কোথা থেকে তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে স্থানীয়ভাবে জানা যায়, খুলনার কিছু সেলুনকেন্দ্রিক গুজব হঠাৎ করেই ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়া, চায়ের দোকান ও বাজার-ঘাটে। বিশেষ করে যখন দেখা যায় কিছু সেলুন গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে, সেখানে অপরিচিত ভাষায় কথা বলছে এমন মানুষদের আনাগোনা, তখন অনেকেই সন্দেহের চোখে বিষয়টি দেখতে শুরু করেন।
একজন সেলুন মালিক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, রাতে আসা অনেকেই হয়তো পথচারী বা কর্মজীবী। তবে কিছু মানুষ আসে, চুল কাটায় না, শুধু বসে থাকে। কেউ কেউ শুধু একটু চুল ছাটিয়ে বলে ‘থ্যাংকস’, তারপর চলে যায়। এটাও ঠিক, তাদের আচরণ একটু ব্যতিক্রম।
তবে কি সত্যিই চলছে তথ্য সংগ্রহ?
সন্দেহ বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, কিছু “এজেন্ট” চুল কেটে নিয়ে যাচ্ছে বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চুল সংগ্রহ করছে। এই চুল নাকি পরে ডিএনএ বিশ্লেষণ, বায়োমেট্রিক ডেটা, অথবা এমনকি ব্ল্যাক ম্যাজিক-এও ব্যবহৃত হতে পারে! যদিও এ দাবি প্রমাণের মতো নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই, তবে জনমনে একধরনের আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে একজন স্থানীয় সাংবাদিক জানান, গল্পটা শুনতে যতটা রহস্যজনক, বাস্তবতা ততটা নয়। তবে কোনো তথ্য শতভাগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজই করে লোকচক্ষুর আড়ালে।
পাকিস্তানের ‘সেলুন অপারেশন’ এর ছায়া?
পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, পাকিস্তানে সেনা ক্যাম্পের আশেপাশের সেলুনগুলো নিয়েও একসময় এমন আলোচনার সৃষ্টি হয়েছিল। বলা হয়, কিছু সেলুনে নিয়মিত যেত এমন কিছু ব্যক্তি আসলে প্রতিপক্ষ গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট ছিল, যারা সেনা কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত চুল সংগ্রহ করত, পর্যবেক্ষণ করত তাদের যাতায়াত।
এখন প্রশ্ন হলো, এমন কিছু কি বাংলাদেশে ঘটছে? প্রতিটি গোয়েন্দা সংস্থার একটি কাজের ধরন থাকে। সাধারণভাবে বলা হয়, তারা প্রতিপক্ষের বেসামরিক জীবনে ঢুকে পড়ে তথ্য সংগ্রহ করে। এক্ষেত্রে সেলুন একটি সহজ প্রবেশযোগ্য জায়গা। কারণ এখানে ব্যক্তিগত আলাপ, দৈনন্দিন রুটিন, এমনকি শারীরিক নমুনা (যেমন চুল, দাড়ি) পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত কী বলছে?
অবসরপ্রাপ্ত এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এটি খুবই স্পর্শকাতর এবং জটিল বিষয়। আমাদের দেশে সেলুন ব্যবস্থাপনা বেশ অনিয়ন্ত্রিত, সেখানে কেউ আসছে বা যাচ্ছে, সেটা নজরে না আসারই কথা। তবে যারা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তাদের এমন জায়গায় সাবধান থাকা জরুরি। তবে গুজব ও সত্যের মাঝখানে একটা স্পষ্ট সীমারেখা থাকা উচিত।
সাইবার সিকিউরিটি গবেষকরা জানান, চুল বা শরীরের অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বায়োমেট্রিক বা জেনেটিক ডেটা হ্যাক করার তত্ত্ব নতুন নয়। তবে তা বাস্তবে করা কতটা সম্ভব, সেটি নির্ভর করে বহু বিষয়ের ওপর। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এই ধরনের কাজ অর্থহীন হলেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা একটি ঝুঁকি হতে পারে।
সতর্কতা না কি আতঙ্ক ছড়ানো?
তথ্য না থাকলে গুজবই ছড়ায় বেশি। এ ধরনের গুঞ্জন নিয়ে কথা বলা যেমন প্রয়োজন, তেমনি যাচাই-বাছাই করে দেখা আরও গুরুত্বপূর্ণ। গুজবের ভিত্তিতে আতঙ্ক ছড়ানো যেমন অনুচিত, তেমনি প্রতিটি সন্দেহজনক কর্মকা-কে গুরুত্ব না দিলে ভবিষ্যতের ঝুঁকির মুখে পড়তে হতে পারে।
খুলনা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা অনানুষ্ঠানিকভাবে বলেন, আমরা এমন কিছু গুজব পেয়েছি, তবে এখনও পর্যন্ত এসব নিয়ে সরাসরি কোনো অভিযোগ আসেনি বা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য মেলেনি। তবে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সবসময়ই এসব বিষয় পর্যবেক্ষণে রাখে।
‘র’ এর এজেন্ট সেলুনে বসে চুল কাটছে, না কি শুধু গুজবের গল্প ঘুরছে, এখনও তার স্পষ্ট উত্তর নেই। তবে গুজবকে হালকাভাবে নেওয়া যেমন ঠিক নয়, তেমনি ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোও অনুচিত। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর উচিত এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তদন্ত চালানো এবং জনগণকে তথ্যভিত্তিক আশ্বস্ত করা। অন্যদিকে, নাগরিকদের উচিত গুজব যাচাই না করে তা ছড়ানো থেকে বিরত থাকা।
শুধু চুল কাটতে এসে কেউ বসে থাকলেই সে ‘র’ এর এজেন্ট, এমন অনুমান করা যেমন অতিরঞ্জিত, তেমনি রাতের আঁধারে অপরিচিতদের আচরণ নজরদারির বাইরে রাখাও বিপজ্জনক। তাই প্রয়োজন সংবেদনশীলতা, সচেতনতা এবং তথ্যনির্ভরতা।