Image description

চট্টগ্রাম শহর থেকে কর্ণফুলী নদী পার হয়ে একদিকে কক্সবাজার আর অন্যদিকে বান্দরবানের আগের সাতটি উপজেলা দক্ষিণ চট্টগ্রাম হিসেবে পরিচিত। অসংখ্য নদী ও খালবেষ্টিত সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠসমৃদ্ধ এলাকাটি রাজনৈতিক সহাবস্থান ও শান্তির জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল।

তবে বিগত দেড় দশক এ অঞ্চলকে রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতীকে পরিণত করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পুলিশ প্রশাসন ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, কর্ণফুলী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, পটিয়া এবং বোয়ালখালী উপজেলার মধ্যে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতবিক্ষত হয় আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের নামে এখানে যা ঘটেছে, তা মানবতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এই দুই উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা, মামলা ও অপহরণের ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এর বাইরে জামায়াতের দুই সক্রিয় কর্মীকে অপহরণের পর নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাও ঘটে সাতকানিয়ায়।

জামায়াতে ইসলামীর নেতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তি আন্দোলনে সাতকানিয়ায় নিহত হয় চারজন। এর মধ্যে একদিনেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় কিশোরসহ তিনজন। ধরে নিয়ে পায়ে গুলি করে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া হয় একাধিক নেতাকর্মীকে। বাঁশখালী আসনের বিএনপিদলীয় সাবেক মন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী একাধিকবার পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনে গুরুতর আহত হয়ে জাফরুল ইসলাম আর রাজনৈতিক মাঠে আসতে পারেননি। এক ডজন মিথ্যা মামলার দায় মাথায় নিয়ে ২০২২ সালে তিনি মারা যান। একই ভাবে বিভিন্ন সময় পুলিশি নির্যাতনে গুরুতর আহত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া পটিয়া উপজেলা জামায়াতের আমির মুকিবুল ইসলাম ফারুকও মারা যান অসংখ্য মিথ্যা মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে।

সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের জামায়াতের সাবেক এমপি আ ন ম সামশুল ইসলাম এবং একই আসনের একাধিকবার নির্বাচত এমপি শাহজাহান চৌধুরীকে মিথ্যা মামলায় কারান্তরীণ রাখা হয় বছরের পর বছর। শাহজাহান চৌধুরীকে কারাগারের নির্জন কক্ষে রাখা হয় প্রায় ২১ মাস।

দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, সাতকানিয়ার বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমান, পটিয়ার এনামুল হক, বিএনপি নেতা লিয়াকত আলী, দক্ষিণ জেলা যুবদল নেতা মোজাম্মেল হক, ছাত্রদল নেতা রবিউল ইসলাম রবি, শিবির নেতা শাহাদাত হোসেনসহ অসংখ্য নেতাকর্মী একাধিকবার হামলা ও শত শত মিথ্যা মামলায় নাজেহাল হয়েছেন।

অপহরণের পর দুই জামায়াতকর্মীকে হত্যা

সাতকানিয়ার জামায়াতকর্মী আব্দুল হাকিম (৪৫) এবং কামাল উদ্দিনকে (৪০) ২০১১ সালের ১ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের শীর্ষ সন্ত্রাসী বশির বাহিনীর প্রধান বশিরের নেতৃত্বে অপহরণ করা হয়। পরদিন আব্দুল হাকিমের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয় সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের রূপকানিয়া এলাকার হাতিয়ার খাল থেকে। এর একদিন পর একই খালের ডলুনদীর মোহনা থেকে উদ্ধার করা হয় কামাল উদ্দিনের লাশ।

পুলিশের গুলিতে ঝরে পড়া প্রাণ

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে স্থানীয় জনতা। এ সময় সাতকানিয়া থানা পুলিশের একটি বিশাল দল কোনো ধরনের সতর্কতা জারি ছাড়াই রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। এতে আহত হন অন্তত অর্ধশত মানুষ। গ্রেপ্তার করা হয় বেশ কয়েকজনকে। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কিশোর শহীদুল ইসলাম (১৩) ও আবু তাহেরের (২৭) মৃত্যু হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান ওসমান গনি (৩০) নামে আরেকজন। এছাড়া পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন একই এলাকার বাসিন্দা আবু ছালেহ (৩৮)। গুলিবিদ্ধ অনেকে এখনো দুঃসহ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন।

কথিত ক্রসফায়ারে হত্যা

২০১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সাতকানিয়ার বার্মা কলোনি এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছদাহা ইউনিয়ন জামায়াতের নেতা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। একই সময় পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে পরে এক পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান মোহাম্মদ রফিক। পঙ্গু মোহাম্মদ রফিক বলেন, জসিমকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। পায়ের সঙ্গে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আমাকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়।

২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর ভোরে পুলিশ পশ্চিম সাতকানিয়া থেকে কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চনা এলাকার জামায়াতকর্মী আবুল বশরকে (৪০) গ্রেপ্তার করে। পরে অস্ত্র উদ্ধারের নামে তাকে ওই দিন ভোরে এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করে কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে বলে দাবি করে পুলিশ। সাতকানিয়া থানার তৎকালীন ওসি ফরিদ উদ্দিন খন্দকারের নেতৃত্বে এএসআই হিরু বিকাশ দে গুলি করে বশরকে হত্যা করেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

জঙ্গি নাটক

বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নের দুর্গম লটমণি পাহাড়ে মুরগির খামার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন মোবারক আলী। ২০১৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে হঠাৎ কয়েক হাজার র‌্যাব সদস্য ঘিরে ফেলে পুরো এলাকা। বলা হয়, খামারের আড়ালে জঙ্গি প্রশিক্ষণ চলত সেখানে। কয়েক ঘণ্টার নাটকীয়তা শেষে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি করা হয় সেখান থেকে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা পাঁচ যুবককে কথিত জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গ্রেপ্তারদের মধ্যে ছিলেনÑফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার মিঠাপুকুর গ্রামের আইয়ুব আলীর ছেলে মোবাশ্বের হোসেন (১৭), ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার গাছোয়াপাড়া গ্রামের নূর মোহাম্মদের ছেলে আব্দুল খালেক হুরাইরা (২১), টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার উড়িয়াবাড়ী গ্রামের চান মিয়ার ছেলে আমিনুল ইসলাম হামজা (২২), একই জেলার মির্জাপুরের মাহমুদপুর গ্রামের দরবেশ আলীর ছেলে হাবিবুর রহমান তাসিম (১৯) এবং গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার কয়েখাঁ গ্রামের মোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আমির হোসেন ইসহাক (২৫)।

তথাকথিত অভিযান শেষে র‌্যাব দাবি করে, লটমণি পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানা তৈরি করে অস্ত্র, বোমা তৈরি ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ হচ্ছিল আজিজুল হক ও পারভেজ নামে দুজনের নেতৃত্বে।

ওই ঘটনার পর চট্টগ্রামের আলেম-ওলামাদের ওপর চলে আরেক দফা নির্যাতন। এর কয়েকদিন পর হাটহাজারীর একটি মাদরাসা থেকে ২৫ জনকে আটক করে র‌্যাব। এর মধ্যে ১২ জনকে লটমণি পাহাড়ের কথিত জঙ্গিসংশ্লিষ্টতায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে ওই মামলায় হাটহাজারী থেকে বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাকে গ্রেপ্তার করে কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার চালানো হয়।

চেয়ারম্যানকে গুম

রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় জামিন চাইতে ঢাকার উচ্চ আদালতের উদ্দেশে রওনা করেন বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং করলডাঙ্গা ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম বাঁচা। সেখান থেকে র‌্যাবের একটি দল তাকে তুলে নিয়ে যায়। আরেক দল বাঁচার গাড়িতে উঠে তার ড্রাইভার বাবুলকে গাজীপুরে নিয়ে যায়। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে বাঁচাকে তুলে নেওয়া হয় বলে ড্রাইভারকে দিয়ে গাজীপুর থানার মাধ্যমে তার পরিবারকে খবর দেওয়া হয়। আজও বাঁচাকে ফিরে পায়নি পরিবার।

ছাদ থেকে ফেলে হত্যা

২০১৩ সালের ১৩ মার্চ গভীর রাতে নগরীর রাহাত্তারপুল এলাকার সৌরভী আবাসিকের একটি বাড়ি ঘিরে ফেলে পুলিশ। বাড়িটিতে জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর ছোট ভাই সাপ্তাহিক সময়ের প্রয়াস পত্রিকার প্রকাশক মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যরা বসবাস করতেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ সদস্যরা শাহজাহান চৌধুরীর খোঁজে প্রতিটি রুমে তল্লাশি শুরু করে। তাকে না পেয়ে ওই বাড়ির নারীদের সঙ্গেও অশোভন আচরণ করে। অভিযানের একপর্যায়ে শাহজাহান চৌধুরীর ভাগনে সাতকানিয়া সরকারি কলেজের মেধাবী ছাত্র মঈনুদ্দিন হাসান মুন্নাকে আটক করে ভবনের ছাদে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে শাহজাহান চৌধুরীর সন্ধান দেওয়ার জন্য মুন্নার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। একপর্যায়ে তাকে ভবনের ছাদ থেকে লাথি মেরে নিচে ফেলে হত্যা করে।

বিএনপি নেতাদের ওপর দফায় দফায় হামলা

২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বর বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ ইউনিয়নে এক ব্যক্তির জানাজা শেষে নগরীতে ফেরার পথে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান। হামলায় তিনিসহ অন্তত ৫০ নেতাকর্মী রক্তাক্ত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার তার বাসায়ও দুই দফা হামলা চালায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। যুবলীগ নেতা জমির উদ্দিনের নেতৃত্বে সংগঠনটির ৩০-৪০ ক্যাডার বিএনপি অফিস ভাঙচুর করে।

২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর বাঁশখালীর সরল ইউনিয়ন এলাকায় নির্বাচনি গণসংযোগকালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ওপর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় জাফরুলসহ অন্তত ১৫ বিএনপি নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হন কর্নেল (অব.) অলি আহমদের ছেলে ওমর ফারুক সানি।

নদভীর গজবি শাসনে চিরতরে পঙ্গু অনেকে

আওয়ামী শাসনামলে এই এলাকায় পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন অন্তত ৩৫ জন। এর মধ্যে চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন নারীসহ পাঁচজন। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর ইন্ধনে পুলিশ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালায়।

২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর রাতে সাতকানিয়ার এওচিয়া-মার্দাশা ইউনিয়নসংলগ্ন পাহাড়তলী আলীনগর এলাকায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) নাজমুল হাসান ও চট্টগ্রামের রিজার্ভ অফিসার কাজী শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল পুলিশ আবু তাহের নামে একজনের খামারবাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে। কথিত অস্ত্র উদ্ধারের নামে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। পরে তার পা কেটে ফেলতে হয়।

কাঞ্চনা ইউনিয়নের কামাল উদ্দিন দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। দেশে এসে এলাকায় ব্যবসা শুরু করলে চোখ পড়ে আওয়ামী চাঁদাবাজদের। চাহিদা অনুযায়ী চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে পশ্চিম সাতকানিয়ার সন্ত্রাসের গডফাদারখ্যাত নজরুল ইসলাম মানিকের অব্যাহত হুমকিতে অতিষ্ঠ হয়ে পরিবারের নিরাপত্তার জন্য চট্টগ্রাম শহরে চলে যান। তারপরও রক্ষা হয়নি। ২০১৪ সালের ৫ জুলাই অসুস্থ মায়ের জন্য ওষুধ আনতে গেলে তাকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের পুলিশ। এ সময় পুলিশের সঙ্গে অওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিক উপস্থিত ছিলেন। পরে কথিত অস্ত্র উদ্ধার অভিযান সাজিয়ে পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে তার পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পুলিশ।

২০১৫ সালের ২৯ আগস্ট নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এনামুল হককে। গভীর রাতে থানায় আসেন নদভীর ভাতিজা মার্দাশা ইউনিয়নের বিনা ভোটের চেয়ারম্যান যুবলীগ নেতা আ ন ম সেলিম উদ্দিন, তার সহযোগী আব্দুশ শুক্কুর ও শাকিল। তারা পুলিশের উপস্থিতিতে এনামুলকে মারধর করেন। এর পর রাতে থানা থেকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে গাড়িতে করে মার্দাশা ইউনিয়ন পরিষদের কাছে পাহাড়ি এলাকায় নেওয়া হয়। সেখানে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।

এনামুল জানান, গুলি করার আগে সাতকানিয়া থানার তৎকালীন এসআই ইমরোজ তারেক তার কাছে সাত লাখ টাকা দাবি করেন। তিনি তিন লাখ টাকা দিতে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু নদভীর নির্দেশে টাকা না নিয়ে গুলি করে তাকে পঙ্গু করে দেয় পুলিশ।

২০১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জামায়াতকর্মী মোহাম্মদ রফিক ও তার বন্ধু জসিম কেঁওচিয়া ইউনিয়নের দস্তিদার হাট এলাকায় জানাজা পড়ে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে কেঁওচিয়া ইউনিয়নের ছদাহা কেঁওচিয়া স্কুল সড়কের বার্মা কলোনি এলাকায় পৌঁছলে পুলিশ সদস্যরা তাদের ওপর গুলি চালায়। রফিক এবং জসিম মোটরসাইকেল ফেলে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় এসআই নাজমুল, এএসআই ইয়ামিন সুমন ও এসআই জুলুশ খান পাঠান তাদের লক্ষ্য করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন। গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সেখান থেকে তাদের টেনেহিঁচড়ে মিনি ট্রাকে তুলে সাতকানিয়া হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখান থেকে তাদের চট্টগ্রামে নেওয়ার সময় পটিয়া শান্তির হাট এলাকায় পুলিশের গাড়ির ভেতরেই এসআই নাজমুল আহত জসিমের পিঠে ফের গুলি করে হত্যা করেন। আহতাবস্থায় রফিককে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়।

পুলিশের নির্যাতন থেকে বাদ যায়নি নারীও। ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর বিকালে চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে কেঁওচিয়া গ্রামের বালম্বার বাড়ি এলাকায় গিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর অতর্কিত গুলি করতে শুরু করে পুলিশ। এ সময় জামায়াতকর্মী ওসমানকে গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় তার বড় বোন সাজেদা বেগম সাজু প্রতিবাদ করলে খুব কাছ থেকে তার পায়ে গুলি করা হয়। পরে তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়।

গায়েবি মামলা

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাত থানায় পাঁচ শতাধিক গায়েবি মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের অন্তত ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। বাদ যাননি এলডিপির নেতাকর্মীরাও। এর মধ্যে সাতকানিয়ায় জামায়াতের বিরুদ্ধে ২৮৮টি, বিএনপির বিরুদ্ধে ৩৭টি, চন্দনাইশে এলডিপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৫টি, জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ১০টি, লোহাগাড়ায় জামায়াত ও বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা হয় দুই শতাধিক। পটিয়ায় বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা অর্ধশতাধিক। এসব মামলায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি মসজিদের ইমাম এবং মাদরাসার শিক্ষকদেরও আসামি করা হতো।

মিথ্যা মামলায় হয়রানি

আমার দেশ-এর দক্ষিণ চট্টগ্রাম প্রতিনিধি শহীদুল ইসলাম বাবর, পটিয়া প্রতিনিধি স্থানীয় হাইস্কুলের সিনিয়র শিক্ষক এটিএম তোহা, দৈনিক ইনকিলাবের পটিয়া প্রতিনিধি নুর হোসেন, যায়যায়দিন প্রতিনিধি ইকবাল হোসেন, সাঙ্গু প্রতিনিধি বেলাল হোসেনসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্তত ২০ সাংবাদিককে গায়েবি মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি করেছে আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রশাসনের কর্তারা।

এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে ১০ জনকে গুলি করে হত্যা

বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারা এলাকায় সরকারি জমির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জমি দখল ও সাগর ভরাট করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নিমার্ণের কাজ শুরু করেছিল শিল্প গ্রুপ এস আলম। পরিবেশবিধ্বংসী ওই প্রকল্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন স্থানীয়রা। এ সময় গ্রামবাসীর ওপর দুই দফায় নির্বিচারে গুলি করে ১০ জনকে হত্যা করে পুলিশ।

প্রথম সংঘর্ষ হয় প্রকল্পের শুরুতে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল। দুদিন ধরে চলা সংঘর্ষে নিহত হন চারজন। ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকল্পের শেষ সময়ে এস আলম গ্রুপের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফের ফুঁসে ওঠেন এলাকাবাসী। এবারো দানবীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পুলিশ। গুলি করে হত্যা করে ছয়জনকে। দুই ঘটনায় পুলিশ ও এস আলম গ্রুপের ভাড়া করা সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হন শতাধিক গ্রামবাসী।

  • প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বাঁশখালী প্রতিনিধি মুহিবুল্লাহ ছানুবি এবং পটিয়া প্রতিনিধি এটিএম তোহা