
ইসরায়েলের দুই বছরের গণহত্যা আর আগ্রাসনে আপাতত যতি টেনেছে যুদ্ধবিরতি; সেই সুযোগে উদ্ধারকর্মীরা গাজার সেইসব বিধ্বস্ত এলাকায় পৌঁছাতে শুরু করেছেন, যেখানে আগে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ‘ওয়াফা’র বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, শুক্রবার যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে গত এক দিনে গাজার বিভিন্ন এলাকায় ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ১৩৫ জন ফিলিস্তিনির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
গাজার আল-শিফা হাসপাতালে ৪৩টি, আল-আহলি আরব হাসপাতালে ৬০টি মরদেহ পৌঁছেছে। বাকি মরদেহগুলো পৌঁছেছে নুসেইরাত, দেইর আল-বালাহ ও খান ইউনিসের বিভিন্ন হাসপাতালে।
শুক্রবার যুদ্ধবিরতি শুরুর আগে ইসরায়েলি বিমান হামলায় আরও ১৯ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আগে আহত এক ব্যক্তি শুক্রবার মারা গেছেন বলে গাজার চিকিৎসা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
গাজা নগরীর দক্ষিণে গাবুন পরিবারের ১৬ সদস্য নিহত হন, ভোরের দিকে তাদের বাড়িতে বোমা পড়ে। শেখ রাদওয়ানে এক ফিলিস্তিনি নিহত হন, খান ইউনিসের কাছে হামলায় মারা যান আরও দুজন।
আল জাজিরা লিখেছে, এসব হামলার কোনোটি যুদ্ধবিরতির পর ঘটেছে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
ধ্বংসস্তূপে ফেরা
গাজা ভূখণ্ডের কিছু অংশ থেকে ইসরায়েলি সেনারা সরে যাওয়ার পর এবং উপকূলীয় আল-রাশিদ সড়ক খুলে দেওয়ার পর, হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি ধ্বংসস্তূপে পরিণত তাদের ঘরবাড়িতে ফেরার দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক যাত্রা শুরু করেছেন।
নুসেইরাত থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক তারেক আবু আজযুম বলেন, “শিশু, নারী, বৃদ্ধ, গাড়ি, ভ্যান, আসবাবে বোঝাই গাধার গাড়ি—সবাই গাজা সিটির দিকে ছুটছে। পরিবারগুলো তাদের অস্থায়ী তাঁবু খুলে নিয়ে যাচ্ছে, যেন নিজেদের ভাঙা বাড়ির ধ্বংসাবশেষের ওপর আবার সেই তাঁবু টাঙিয়ে আশ্রয় নিতে পারে।”
তিনি বলেন, “তাদের এই ফেরার যাত্রাকে বলা হচ্ছে ঐতিহাসিক, কিন্তু মানবিক সংকট লাঘবের কার্যকর পদক্ষেপও এখন খুব দরকার।”
আল জাজিরা লিখেছে, গাজার অবস্থা এমন যে, মাসের পর মাস ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের পর সেখানে প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। না অবকাঠামো, না বিশুদ্ধ পানি, না বিদ্যুৎ। কেবল কঙ্কালসার ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে, যেখানে একসময় জীবন ছিল।
দেইর আল-বালাহ থেকে আল জাজিরার মোয়াজ খাললুত বলেন, “ফিরে আসা পরিবারগুলোর এখন জরুরি ভিত্তিতে তাঁবু আর অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা দরকার। হাতে সামান্য যা কিছু আছে, তা নিয়েই তারা অজানার পথে হাঁটছে।”
‘অবিশ্বাস্য সয়ে যাওয়া, আশা আঁকড়ে বাঁচা’
অকল্পনীয় ক্ষতির পরও ফিলিস্তিনিরা ফিরে আসার সংকল্পে অটল।
নিজের অস্থায়ী তাঁবুটি গাড়িতে তুলতে তুলতে নাঈম ইরহিম আল জাজিরাকে বলেন, “আমি গাজা সিটিতে যাচ্ছি, যদিও সেখানে জীবনধারণের কোনো উপযুক্ত পরিবেশ নেই; থাকার জায়গা নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই। সবকিছুই খুব কঠিন, কিন্তু আমাদের ফিরতেই হবে।
“আমার ছেলে নিহত হয়েছে, মেয়েরাও আহত। তবু আমি ফিরব। তাঁবু গেড়ে থাকব, যেভাবেই হোক বাঁচব।”
অনেকের জন্য গাজা সিটিতে ফেরার অর্থ কেবলই ধ্বংসস্তূপের মুখোমুখি হওয়া।
মোয়াজ খাললুত বলেন, “প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইসরায়েলি আগ্রাসনের মধ্যেও ফিলিস্তিনিরা বিস্ময়কর সহ্যক্ষমতা দেখিয়েছে। তাদের ফিরে আসা কেবল ঘরে ফেরা নয়, এটা প্রতিরোধ আর আশার প্রতীক।”
ইসরায়েলের গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া আইশা শামাখ বলেন, “আমরা আমাদের বাড়িগুলো দেখতে চাই, যেগুলো যুদ্ধের শুরুতেই ধ্বংস করা হয়েছে। আমাদের সন্তানদের ওপর ছাদ ভেঙে পড়েছে। তবু যুদ্ধবিরতির এই আনন্দ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।”
মৃত্যুর মাঝেও জীবনের টান
গাজা সিটি থেকে আল জাজিরার ইব্রাহিম আল-খালিল বলেছেন, বাড়ি ফেরার পথে মানুষের ক্লান্ত মুখগুলোতে একই সঙ্গে শোক আর আনন্দের ছাপ তিনি দেখেছেন।
“অনেকে আমাকে বলেছে তারা জানে না তাদের বাড়ি এখনও টিকে আছে কিনা, নাকি ধ্বংসস্তূপে মিশে গেছে; তবু তারা ফিরে এসেছে আশাকে আঁকড়ে ধরে।”
উত্তরমুখী কষ্টকর যাত্রা শেষে গাজায় ফেরা আহমেদ আবু শানাব বলেন, “আমরা প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছি। জায়গা ছিল না, আমরা ঠিকমতো ঘুমাতেও পারিনি।”
মারিয়াম আবু জাবাল নামে আরেকজন বলেন, “আমরা ফিরেছি অজানার পথে। জানি না আমাদের বাড়ি এখনো আছে কিনা। আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আমাদের ঘরটা যেন এখনও অটুট থাকে।”
সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত শেখ রাদওয়ান এলাকায় ফিরে আসা মোহাম্মদ শরাফ বলেন, “সবকিছু বদলে গেছে। আমরা ফিরেছি এমন এক বিপর্যয়ের মধ্যে, যা কল্পনারও বাইরে। ভেবেছিলাম কয়েক দিনের জন্য যাচ্ছি, কিন্তু ফিরে এসে দেখি—কিছুই নেই।”
আল জাজিরা লিখেছে, মৃত্যু, শোক আর ধ্বংসের মধ্যেও ঘরে ফেরার এই তীব্র আকুতি প্রমাণ করে, ইসরায়েলের হাতে দেশ থেকে মুছে যাওয়ার বা বিতাড়িত হওয়ার ভয়কে ফিলিস্তিনিরা কখনও মেনে নেয়নি, নেবে না।