
যুক্তরাজ্য সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের পাশে বসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেছিলেন, তিনি প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার (৪ হাজার ৯৭০ মাইল) দূরের একটি জায়গার দিকে নজর রাখছেন, যা একসময় তাঁর দেশের সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেটি হচ্ছে আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমরা ঘাঁটিটি (তালেবানকে) বিনা মূল্যে দিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা ওই ঘাঁটি ফেরত চাই।’
এর দুই দিন পর আবার নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের মতামত প্রকাশ করে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘যারা বাগরাম বিমানঘাঁটি তৈরি করেছিল, সেই যুক্তরাষ্ট্রকে যদি আফগানিস্তান এটি ফেরত না দেয়, তাহলে খুব খারাপ কিছু ঘটতে পারে।’
তালেবান প্রত্যাশিতভাবেই এ দাবিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং জোর দিয়ে বলেছে, ‘কোনো পরিস্থিতিতেই’ আফগানরা এ ঘাঁটি কোনো তৃতীয় দেশের হাতে তুলে দেবে না।
২০২১ সালের আগস্টে কাবুল দখলের পর থেকে আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতায় আছে তালেবান। দেশটিতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রত্যাবর্তনের বিরোধিতায় গত মঙ্গলবার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে এক অভূতপূর্ব সমর্থন পেয়েছে তালেবান। এই প্রতিবেশীদের মধ্যে এমন অনেক দেশও ছিল, যাদের মধ্যে ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে খুব কমই মতের মিল আছে।
গত মঙ্গলবার মস্কোতে চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও কিরগিজস্তানের কর্মকর্তারা তালেবান কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে অংশ নেন। সেখানে তাঁরা আফগানিস্তানে বিদেশি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের যেকোনো চেষ্টার কঠোর বিরোধিতা করেন। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের নামোল্লেখ না করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লক্ষ্য কে ছিল, তা স্পষ্ট।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ৭ অক্টোবর দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, তারা আফগানিস্তান ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে যেকোনো দেশের সামরিক অবকাঠামো স্থাপনের চেষ্টাকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করে। কারণ, এটি আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থ রক্ষা করবে না।
আফগানিস্তানের প্রতিবেশীদের মধ্যে ‘মস্কো ফরম্যাট কনসালটেশনস’ নামে পরিচিত এ বৈঠকের সপ্তম সংস্করণ শেষে এ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
গত মাসে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া ও ইরান একটি অনুরূপ ঘোষণায় ‘সামরিক ঘাঁটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা’র বিরোধিতা করেছিল। মস্কোর এ ঘোষণাপত্র স্বার্থের সংঘাতও রয়েছে, এমন আরও অনেক দেশকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছে।
ভারত ও পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে। ওই দেশে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ নিয়েও ভারত উদ্বিগ্ন। ইরান প্রায়ই আফগানিস্তানে পাকিস্তানের যেকোনো উপস্থিতিকে সন্দেহের চোখে দেখে।

কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে আশঙ্কা করছে, আফগানিস্তানের সহিংসতা তাদের ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কে বেশ উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। তবে এই তালেবানকে পাকিস্তান কয়েক দশক ধরে সমর্থন ও আশ্রয় দিয়ে আসছিল।
ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইসলামাবাদের (আইএসএসআই) গবেষক তৈমুর খানের মতে, এই মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রকে এ অঞ্চল থেকে দূরে রাখতে এসব দেশের সর্বসম্মত অবস্থান প্রমাণ করছে, আফগান বিষয়গুলো ‘আঞ্চলিক বিষয়’, যা বাইরে থেকে পরিচালনার বিষয় নয়।
তৈমুর খান আল-জাজিরাকে বলেন, তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আঞ্চলিক দেশগুলোর একটি সাধারণ অবস্থান হচ্ছে আফগানিস্তানে আবার কোনো বিদেশি সামরিক শক্তির উপস্থিতি থাকা মোটেই ঠিক নয়।
মস্কোতে ব্যক্ত করা এই যৌথ ঘোষণা তালেবানের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। কারণ, তারা বাগরাম নিয়ে ট্রাম্পের চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইছে। একই সঙ্গে এটি আফগানিস্তানের শাসকদের আঞ্চলিক বৈধতাও দেয়।
অবশ্য এখন পর্যন্ত শুধু রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে আফগান সরকার হিসেবে তালেবানকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বেশির ভাগ প্রতিবেশী দেশ তাদের সঙ্গে কেবল সম্পর্ক গভীর করছে।
প্রতীকী ও কৌশলগত সম্পদ
আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতায় ফেরার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ২০২০ সালের জানুয়ারিতে দোহায়। তখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় ছিলেন ট্রাম্প। ২০২১ সালের আগস্টে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মেয়াদে তালেবান দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।
তবু এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নেওয়ার এক মাস পর ডোনাল্ড ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা বাগরাম ঘাঁটি রাখতে চেয়েছিলাম। আমরা বাগরামে একটি ছোট বাহিনী রাখতে চেয়েছিলাম।’
কাবুলের ৪৪ কিলোমিটার (২৭ মাইল) উত্তরে অবস্থিত বাগরাম মূলত ১৯৫০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি করেছিল। ঘাঁটিটিতে দুটি কংক্রিটের রানওয়ে রয়েছে। এটি আফগানিস্তানের কয়েকটি জায়গার মধ্যে একটি, যা বড় সামরিক বিমান ও অস্ত্রবাহী উড়োজাহাজের ওঠা–নামার জন্য উপযুক্ত।
অর্ধশতাব্দী ধরে আফগানিস্তান দখল, নিয়ন্ত্রণ ও যুদ্ধ করা অনেক শক্তির জন্য এই বাগরাম ঘাঁটি একটি কৌশলগত অবস্থান হয়ে উঠেছিল। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায়। তাদের আগ্রাসনের পর বাগরাম ওয়াশিংটনের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ একটি কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হয়ে ওঠে।
আফগানিস্তানের বন্ধুর, পার্বত্য অঞ্চলের কারণে বড় সামরিক লজিস্টিক হাব হিসেবে ব্যবহার করার মতো জায়গা খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্র এই দেশটি ছেড়ে যাওয়ার চার বছর পরও বাগরামের কৌশলগত গুরুত্ব তাই এখনো অনেক বেশি।

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক নিউ লাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির সিনিয়র ডিরেক্টর কামরান বোখারি বলেছেন, ট্রাম্পের মন্তব্য সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সেনা পুনরায় মোতায়েনের কোনো পরিকল্পনা করছে বলে তিনি মনে করেন না।
বোখারি আল-জাজিরাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভূকৌশল হচ্ছে সামরিক সংকোচন। ওয়াশিংটনে এ ধরনের কোনো সামরিক প্রতিশ্রুতির আগ্রহ নেই।
একই সঙ্গে বোখারি বলেন, মস্কো বৈঠক রাশিয়ার জন্য মধ্য এশিয়ায় তার প্রভাব তুলে ধরার একটি সুযোগ ছিল।
তবে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক উপস্থিতির চেষ্টা কেবল রাশিয়া বা চীনের জন্য উদ্বেগের বিষয় নয়; যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে তীব্র উত্তেজনার মধ্যে ইরানও আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি চাইবে না।
বোখারি বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মতো অন্য আঞ্চলিক দেশগুলোও বলতে চাইছে, আফগানিস্তানে মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারে কোনো শূন্যতা সৃষ্টি করবে না। বরং এই প্রতিবেশীরাই সেখানে এই শূন্যতা পূরণ করতে পারবে।
আর মধ্য এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে যাদের সঙ্গে আফগানিস্তানের দীর্ঘ ও অরক্ষিত সীমান্ত রয়েছে, তারা ভয় পাচ্ছে, বাগরামে মার্কিন সামরিক বাহিনী ফিরে এলে সহিংস অনেক গোষ্ঠী তাদের মাটি ব্যবহার করতে পারে।
মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তা সমীকরণ
বিশ্লেষকেরা যুক্তি দেন, এ অঞ্চলে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি এসব দেশের অনেকে ‘অবাঞ্ছিত’ হিসেবে দেখবে।
কাজাখস্তানের বিশ্লেষক এবং সেন্ট্রাল এশিয়া রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন ইনস্টিটিউটের (সিএআরইসি) উপপরিচালক কুয়াত আকিঝানভ বলেন, এটা কেবলই গতানুগতিক মার্কিনবিরোধিতা নয়।
আকিঝানভ যোগ করেন, আঞ্চলিক শক্তিগুলো এখন নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য মস্কো ফরম্যাট, এমনকি মস্কো ও বেইজিংয়ের নেতৃত্বাধীন সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) মতো আঞ্চলিক গোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করতে পছন্দ করে।

আফগানিস্তানের অন্য প্রতিবেশীরা কী ভয় পায়
ইসলামাবাদভিত্তিক আইএসএসআইয়ের তৈমুর খান বলেন, তাদের আশঙ্কা হচ্ছে, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি সম্ভাব্যভাবে গোয়েন্দা কার্যক্রম ফিরিয়ে আনতে পারে, অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে। আফগানিস্তানকে আবারও একটি প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাগরাম ঘাঁটি ‘ফিরিয়ে দেওয়ার’ ট্রাম্পের দাবি তালেবানের জন্য উভয়সংকট তৈরি করেছে।
কাবুলভিত্তিক ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক ইব্রাহিম বাহিস বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, ট্রাম্পের বাগরাম ঘাঁটি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি মার্কিন কৌশলগত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঐকমত্যের চেয়ে বরং মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘ব্যক্তিগত ইচ্ছা’ বলে মনে হয়েছে।
বাগরাম ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা তালেবানের জন্য অকল্পনীয়। বিশ্লেষক বাহিস বলেন, কাবুল বাগরাম ছেড়ে দিতে পারে না। কারণ, এটি তাদের নিজস্ব সমর্থক গোষ্ঠীকেও ক্ষুব্ধ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এখানে এলে তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াইয়েরও জন্ম হতে পারে
সম্পৃক্ততা, স্বীকৃতি নয়
২০২১ সালের আগস্টে চার কোটির বেশি মানুষের একটি দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে তালেবান তাদের শাসনব্যবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সন্দেহের মুখে পড়েছে। আফগানিস্তানের তালেবান শাসক জনগণের ওপর কঠোর ইসলামি অনুশাসন চাপিয়ে দিয়েছে। নারীদের কাজ–শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
এর বাইরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আফগানিস্তানের দুর্বল অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করেছে। আবার তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি), বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) এবং ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশসহ (আইএসকেপি) আফগানিস্তানে একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
একসময় তালেবানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত পাকিস্তান বলেছে, জঙ্গিদের দমনে আফগান সরকারের ব্যর্থতায় গত চার বছরে তারা ক্রমশ হতাশ হয়েছে।
তবু গত মে মাসে পাকিস্তান তালেবানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করেছে। ওই মাসে আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। মুত্তাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ইরান ও চীনে যান।
বাহিস বলেন, সাধারণ ও বাস্তবসম্মত লক্ষ্যের কথা বিবেচনা করে আঞ্চলিক দেশগুলোর তালেবানের সঙ্গে কাজ করার অনেকটা বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। যেমন এর মধ্যে রয়েছে সীমান্ত শান্ত রাখা, সন্ত্রাস বন্ধে তাদের সহযোগিতা নিশ্চিত করা এবং বাণিজ্য পথ সুরক্ষিত করা।
আইএসএসআইয়ের তৈমুর খান এসব বিষয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যা দেখছি, তা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নয়, বরং একটি কার্যকর বোঝাপড়া। কারণ, আফগানিস্তান বিচ্ছিন্ন থাকলে সেটা কারও স্বার্থে কাজ করবে না।’