
আব্বাস উদ্দিনের কালজয়ী গান ওকি গাড়িয়াল ভাই ... হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে ...। সেই হারিয়ে যাওয়া বন্দরের ঐতিহ্য ফেরানোর চেষ্টার পালে হাওয়া লেগেছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানা জটিলতায় গতিহীন ছিল ‘চিলমারী এলাকায় (রমনা, জোড়গাছ, রাজিবপুর, রৌমারী, নয়ারহাট) নদীবন্দর নির্মাণ’ প্রকল্প। শুধু ভূমি অধিগ্রহণেই কেটে যায় ৪ বছর। তবে অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পের গতি ফিরিয়ে এনেছে। কেটে গেছে ভূমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য জটিলতা। চলছে বিভিন্ন ভবন নির্মাণ কাজ। পাশাপাশি নদীর তীর রক্ষাসহ প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল তৈরির কাজও চলছে জোরেশোরে। তবে এখন অধিগ্রহণ করা জমি থেকে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করাই হলো বড় চ্যালেঞ্জ। এটি সঠিকভাবে করা গেলে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই প্রকল্পটি শেষ করা সম্ভব হবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, ‘আড়াই একর জমি আগে থেকেই পাওয়া গেছে। আর ১০ একর জমি অধিগ্রহণের ৮০ ভাগ কাজ শেষ। আগামী সপ্তাহেই অধিগ্রহণের পুরো টাকা পরিশোধ সম্ভব হবে। ইতোমধ্যেই প্রশাসনিক ভবন, বন্দর ভবন, প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল, পরিদর্শন বাংলো তৈরির কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। ২০০ মিটার পাইলিংসহ তীর সংরক্ষণ কাজ প্রায় শেষের পথে। আরও ৩০০-৪০০ মিটার পাইলিং করা হয়েছে। অন্যান্য কাজও এগিয়ে চলছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ২৩ শতাংশ এবং আর্থিক ২১ শতাংশ। আশা করছি বর্ধিত মেয়াদের আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।’
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পের সংশোধনীর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল এটির অনুমোদিত ব্যয় ২৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। কিন্তু মার্চ পর্যন্ত খরচ হয়েছে সাত কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছিল ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৮ শতাংশ। অনুমোদনের সময় প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর আগে একবার ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে রংপুর বিভাগের অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর এবং গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকায় নৌপরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত হবে। পাশাপাশি নৌ-বাণিজ্য ও অতিক্রমণ প্রটোকলের আওতায় ভারতের আসাম, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম কেন্দ্র হতে পারে। আরও বলা হয়েছে, চিলমারী বন্দরটি কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত। জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে। এছাড়া চিলমারীর রমনা রেলস্টেশন থেকে ৫০০ মিটার পূর্বে অবস্থিত এ বন্দর এক সময় কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয়, যাত্রী ও মালামালের অন্যতম প্রধান স্থানীয় বন্দর হিসাবে পরিচিত ছিল। এই বন্দরের প্রধান সুবিধা ছিল প্রায় ১৫টি নদীর সংযোগস্থলে এটি অবস্থিত। এগুলোর অন্যতম হলো-ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ফুলকুমার, গঙ্গাধর, গদাধর ও জিনজিরাম নদী। এক সময় অবিভক্ত ভারতের আসামের ধুবরী, গৌহাটি এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকেও এখানে জলযান নোঙর করত। এখানে ছিল কাস্টম স্টেশনও। কিন্তু পরে দেশ ভাগ ও নদীর ভাঙনে দিনে দিনে এই বন্দরের গুরুত্ব কমে যায়। তবে এখনো প্রতিদিন প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ যাত্রী এ এলাকা দিয়ে যাতায়াত করেন। বিভিন্ন উৎসবের সময় সর্বোচ্চ ১২০০ থেকে ১৫০০ যাত্রী হয়ে যায়। এখন শুধু চিলমারী ও রৌমারীর মধ্যেই প্রতিদিন ৮-৯টি বৃহৎ জলযান চলাচল করছে। চিলমারী ও রাজিবপুরের মধ্যেও এরকম জলযান চলাচল করছে। এছাড়া ৭০-৮০ টন মালামাল প্রতিদিন এই বন্দরে ওঠানামা করে। বর্ষাকালে বন্দরের ব্যবহার বহুগুণ বেড়ে যায়। ধান, চাল, গম ইত্যাদি পণ্য দেশের দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত এই বন্দর দিয়ে পরিবহণ করা হয়। পাশাপাশি পাট, পাটশলা, দিয়াশলাইয়ের কাঁচামাল তুলাকাঠ এই বন্দর দিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পরিবহণ হয়। এ প্রেক্ষাপটে বন্দর উন্নয়নে প্রকল্পটি হাতে নেয় নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু কিছু নতুন অঙ্গের অন্তর্ভুক্তি, রেট শিডিউল পরিবর্তন, বিভিন্ন কাজের পরিমাণ ও ব্যয় বাড়া ও কমার কারণে প্রকল্পের প্রথম সংশোধন করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পটি সংশোধনীর প্রস্তাব পাওয়ার পর পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভা করে পরিকল্পনা কমিশন। সেখানে বিভিন্ন সুপারিশ দেওয়া হয়। সেগুলো প্রতিপালন করে সংশোধিত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। সেটি যাচাই-বাছাই করে অনুমোদনের জন্য একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদনের জন্য উপস্থাপনের অনুমতি চাওয়া হয় পরিকল্পনা উপদেষ্টার কাছে। প্রায় এক মাস সেখানে পড়ে থাকার পর উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সেটি ফেরত পাঠানো হয় কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে। এরপর প্রকল্পের যৌক্তিকতা আছে কিনা সেটি অধিক যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ফেরত দেওয়া হয়। সব জটিলতা পার হয়ে সম্প্রতি প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন মেলে। আর এর মধ্যদিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের পালে হাওয়া লেগেছে।