
শরণার্থী শিবির, রাস্তা-ধ্বংসস্তূপের পাশের তাঁবুজীবন শেষে ঘরে ফিরছে গাজাবাসী। চোখে-মুখে হারানো সংসার ফিরে পাওয়ার আনন্দ। ইসরাইলের বোমা হামলায় গুঁড়িয়ে যাওয়া, ধসে যাওয়া আবাসস্থলে আবার নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্ন। বিধ্বস্ত উপত্যকায় শুরু হওয়া জীবনের এই নতুন আলোড়নের মাঝেই নেমে আসছে সেই পুরোনো বিষাদের ঢেউ-ধ্বংসস্তূপ সরাতেই বেরিয়ে আসছে পচাগলা লাশ। অজানা আশঙ্কায় মুহূর্তে সজল হয়ে উঠছে বাসিন্দার স্বজনহারা চোখ! তবে এসবের মধ্যেও সবচেয়ে বড় আনন্দটি হলো-শুক্রবার প্রথমবার একটি শান্তিপূর্ণ রাত কাটাল গাজাবাসী। যা তারা গত দুই বছরে কল্পনাও করতে পারেনি। রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাত আর অন্তহীন আতঙ্কের পর অবশেষে এক নিঃশব্দ রাত কাটাল গাজাবাসী। আকাশে ড্রোন নেই। বোমা বিস্ফোরণের শব্দ নেই। চারদিকে নিস্তব্ধতা আর খুশির আমেজ। তবে প্রথম দফার যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও পরবর্তী আলোচনা বা স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে শঙ্কা এখনো কাটেনি। পূর্ণ যুদ্ধবিরতি প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছে-গাজায় আন্তর্জাতিক শাসন বা ট্রাম্পের ’পিস বোর্ড’। যা যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রত্যাখ্যান করেছে হামাস ও তার সহযোগী দলগুলো। আলজাজিরা, এএফপি, সিএনএন।
বুধবার রাতে এ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৃহস্পতিবার রাতে নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভায় পাশ হওয়ার পর শুক্রবার দুপুর ১২টা (স্থানীয় সময়) থেকে কার্যকর হয় এ যুদ্ধবিরতি। এরপর থেকে ধীরে ধীরে উপত্যকা থেকে সরে যেতে শুরু করে সেনারা। যুদ্ধের ধুলো-ধোঁয়া কাটিয়ে, বিধ্বস্ত রাস্তায়, ভাঙা ঘরের দিকেই ফিরতে শুরু করে ক্লান্ত, ক্ষতবিক্ষত গাজাবাসীরা। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস ও রাফাহ থেকে উত্তরমুখী হতে শুরু করে হাজার হাজার মানুষ। কেউ হেঁটে, কেউ ভাঙাচোরা গাড়িতে, কেউ আবার ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তায় শিশুদের কাঁধে নিয়ে ফিরছে নিজ ভূমিতে। যদিও অনেকেই তাদের ঘর-বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না, তবুও তাদের চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ। ৩২ বছর বয়সি আমির আবু ইয়াদে বলেন, ‘আমরা ফিরছি আমাদের ভূমিতে, যেখানে শুধু ধ্বংস আর ক্ষতচিহ্ন ছাড়া কিছুই নেই। তবু আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই, অন্তত এখন আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছি।’ যুদ্ধবিরতির খবর শোনার পর থেকেই খাবারের দামও কমতে শুরু করেছে গাজায়। তবে স্বস্তির মাঝে রয়েছে শোকের ছায়াও। কারণ ধ্বংসস্তূপ থেকে একের পর এক বের হচ্ছে লাশ। গাজার সিভিল ডিফেন্স সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর গাজা সিটির বিভিন্ন এলাকা থেকে ৬৩টি মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।’ এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আলজাজিরার হিন্দ খোদারি বলেন, ‘আজ (শুক্রবার) রাতে গাজার ওপর কেবল আশার আলো। কোনো ড্রোন নেই। কোনো বোমা নেই। কমলা আকাশ নেই, কেবল নীরবতা। এখানে এটা এত বিরল যা প্রায় অদ্ভুত লাগছে। তিনি আরও বলেন, কয়েক মাসের মধ্যে এটাই প্রথম রাত যেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকায় বিমান হামলা হচ্ছে না বা অ্যাম্বুলেন্স ছুটে বেড়াচ্ছে না। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘ড্রোন বন্ধ হয়ে গেছে এবং আর কোনো শব্দ নেই। আমরা নিরাপদ, আমাদের সন্তানরা নিরাপদ। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একত্রিত হয়েছি, এটা আমাদের জন্য খুবই ভালো।’ এক নারী আলজাজিরাকে বলেন, যুদ্ধবিরতিতে আমি খুশি। আমি বাজারে গিয়ে আমার বোনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমি তাকে দুই বছর ধরে দেখিনি। তাকে দেখে আমার হৃদয় আনন্দে ভরে উঠেছে। যুদ্ধবিরতির খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা গাজায় ছড়িয়েছে দেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। ফিলিস্তিনি ফটোগ্রাফার আনাস আয়্যাদের প্রকাশিত এক ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে, বুধবার রাতে বিদ্যুৎহীন গাজার অন্ধকার রাস্তায় তারা চিৎকার করে মানুষজনকে জানান-যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে।
শাসক ঠিক করবে ফিলিস্তিনের জনগণ : দীর্ঘ প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি গাজা উপত্যকায় কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অঞ্চলটির ভবিষ্যৎ শাসনকাঠামো নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তীব্র হয়েছে। হামাস এবং তাদের সহযোগী ফিলিস্তিনি উপদলগুলো দৃঢ়ভাবে ট্রাম্পের ‘পিস বোর্ড’ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, গাজার প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেমন হবে, তা সম্পূর্ণভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ বরদাশত করা হবে না। আলজাজিরা।
শুক্রবার প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ এবং পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন হামাসের সঙ্গে একমত পোষণ করে ফিলিস্তিনিদের অবিচল থাকার প্রশংসা করেছে। তারা দাবি করেছে, এই দৃঢ়তাই গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির ইসরাইলি পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। বিবৃতিতে গোষ্ঠীগুলো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছে, ‘আমরা যে কোনো ধরনের বিদেশি অভিভাবকত্ব প্রত্যাখ্যান করছি এবং জোর দিয়ে বলছি, গাজা উপত্যকা ও এর সংস্থাগুলোর প্রশাসনের প্রকৃতি আমাদের জনগণের দ্বারা সরাসরি নির্ধারিত হবে।’