
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে। এ মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আজ (রোববার) দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এদিন, ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের কার্যক্রম বিটিভি’র মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে বলে এক ভিডিও বার্তায় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর গাজী এসএইচ তামিম। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী, প্রথমে রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। পরে, আসামি পক্ষের আইনজীবীরা তাদের যুক্তিতর্ক তুলে ধরবেন, পরে রাষ্ট্রপক্ষ এর জবাব দিবেন। এটি হলো মামলার সর্বশেষ ধাপ। পরে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হবে।
এর আগে গত বুধবার মামলায় সর্বশেষ সাক্ষী ও মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরকে তৃতীয় দিনের মতো জেরা করেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। পরে, ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের এ দিন ধার্য করেন। সবমিলিয়ে মোট ২৮ কার্যদিবসে এ মামলায় ৫৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এবার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আজ মামলাটির দিন ধার্য হলো।
মামলার অন্যতম আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও ৩৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। নিজের দায় স্বীকার করে আগেই হয়েছেন রাজসাক্ষী। এ ছাড়া সাক্ষীদের জবানবন্দিতে গত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে দেশ জুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর বীভৎস বর্ণনা উঠে এসেছে। আর এসবের জন্য দায়ী করে শেখ হাসিনা, কামালসহ জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন শহীদ পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা।
২৮শে সেপ্টেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীরের জবানবন্দি শুরু হয়। ওইদিন তার জব্দকৃত ১৭টি ভিডিও ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত হয়। এসব ভিডিওতে জুলাই-আগস্টের নির্মমতা ফুটে ওঠে। ২৪শে সেপ্টেম্বর এ মামলার ২২তম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়। ওইদিন সাক্ষ্য দেন বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা। পরে তাকে জেরা করেন আমির হোসেন। পরে, গত ২৯শে সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়দিনের মতো জবানবন্দিতে জুলাই আন্দোলনের নৃশংসতা নিয়ে যমুনা টেলিভিশনের একটি প্রতিবেদন, ৫ই আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়। এমনকি জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর তিন লাখ পাঁচ হাজার গুলি ছোড়া হয়েছিল বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন তিনি। তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি সরাসরি সম্প্রচার করা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এ ছাড়া বিবিসি, আল-জাজিরা, আমার দেশে প্রচারিত প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হয়। এরপর, গত ৩০শে সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে তৃতীয়দিনের মতো সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর। ৬ই অক্টোবর এ জেরা শুরু হয়। গত মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের মতো জেরা শেষ করেন আমির হোসেন। জবানবন্দিতে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন তিনি। এর মধ্যে গত বছরের জুলাই আন্দোলন চলাকালীন ৪১টি জেলার ৪৩৮টি স্থানে হত্যাকাণ্ড ও ৫০টিরও বেশি জেলায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
গত ১০ই জুলাই শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার ও শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে। গত ১২ই মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
এদিকে, মামলার সর্বশেষ সাক্ষীকে জেরা শেষে আসামি শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন মনে করেন, আসামি শেখ হাসিনা খালাস পাবেন। তিনি বলেন, সাক্ষীরা যে সমস্ত জবানবন্দি দিয়েছেন, সেসবের মধ্যে অনেকগুলো অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। সাক্ষীরা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে কথা বলেছেন, ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দিতে এসে সেসব কথা বলেন নাই। তাছাড়াও, শেখ হাসিনাকে লেথাল উইপেন ব্যবহারের যে নির্দেশদাতা হিসেবে যেসব ডকুমেন্ট আনা হয়েছে, আমি মনে করি সেগুলো বানানো মিথ্যা ডকুমেন্ট। কিন্তু মাননীয় ট্রাইব্যুনাল কি মনে করবেন এটি তাদের ব্যাপার বলে জানান তিনি।