
দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই ঝরছে তাজা প্রাণ। এ সব নিহতের মধ্যেই বেশির ভাগই মোটরসাইকেল আরোহী। মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনা রোধে হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। শুধু চালক নয়, আরোহীকে ও হেলমেট পরায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। নো হেলমেট, নো ফুয়েল-নীতি গ্রহণ করে সরকার। তাতেও কাজ হয়নি। এড়ানো যাচ্ছে না দুর্ঘটনা। চালক ও পরিবহন দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহারে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছে।
মোটরযান চলাচল আইনের ৪৯-চ ধারায় বলা হয়েছে, চালক ছাড়া মোটরসাইকেলে একজনের অধিক সহযাত্রী বহন করা যাবে না। চালক ও সহযাত্রীকে যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করেন, তাহা হইলে উক্ত লঙ্ঘন হইবে একটি অপরাধ। এজন্য তিনি অনধিক ৩ (তিন) মাসের কারাদণ্ড, বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষসূচক ১ (এক) পয়েন্ট কাটা যাবে। কিন্তু ওই আইনে হেলমেটের ধরন কী হবে সেটি উল্লেখ নেই। দেশে হেলমেটের মান নির্ণয়ের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সেই সুযোগটি নিয়ে অরক্ষিত চলাচল চলছে মোটরসাইকেল ও এর যাত্রীরা। আইন অনুযায়ী কারাদণ্ড ও জরিমানা এড়াতে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের হেলমেট।
সড়ক-মহাসড়কে এখন প্লাস্টিকের তৈরি কম দামি হেলমেট বেশি দেখা যায়। ওই সকল হেলমেটের দাম ১৫০ টাকা থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। সহজে বহনযোগ্য, আলো-বাতাসের কমতি নেই। যারা হেলমেট ব্যবহার করতেন না তারাও এরকম মানহীন হেলমেট ব্যবহার করেন বাধ্য হয়ে। আগে ওই হেলমেটগুলো নির্মাণশ্রমিকদের ব্যবহার করতে দেখা যেতো। প্লাস্টিকের হেলমেট সাধারণত মাথায় ইটপাথর বা হালকা কোনো বস্তু পড়া থেকে সুরক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে বানানো হয়। এগুলোতে কোনো শক-অ্যাবজার্বার (ঝাঁকুনি সহনীয় করা) ও ফোম প্যাডিং বা ইমপ্যাক্ট রেজিস্ট্যান্স প্রযুক্তি থাকে না। মানসম্মত হেলমেট আন্তর্জাতিকভাবে মান নিয়ন্ত্রিত থাকে। একাধিক স্তর, শক্তিশালী ফাইবারগ্লাস/পলিকার্বোনেট ও অভ্যন্তরীণ ফোম ইত্যাদি সম্মিলিত সুরক্ষার মাধ্যমে মাথায় আঘাত শোষণ করে।
সম্প্রতি রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে স্ট্যান্ডার্ড হেলমেট অ্যাডভোকেসি ইভেন্টে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্র্যাকটিস ম্যানেজার (ট্রান্সপোর্ট) ফেই ডেং বলেন, মোটরসাইকেল চালকরা সড়কে ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। মানসম্পন্ন হেলমেট ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্ঘটনায় গুরুতর মাথার আঘাতের আশঙ্কা ৬৯ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে সক্ষম।
ওদিকে, দেশে আগে পূর্ণাঙ্গ হেলমেট টেস্টিং বা মান নির্ণয়ের কোনো সুযোগ না থাকলেও গত বছরের জুলাইয়ে দেশের প্রথমবারের মতো অত্যাধুনিক হেলমেট টেস্টিং ল্যাবরেটরি চালু করে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। এর মাধ্যমে সব ধরনের হেলমেটের মান যাচাই করা হয়। মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই বিএসটিআই’র লোগো সংযুক্ত করা যাবে সংশ্লিষ্ট হেলমেটে। এই লোগোযুক্ত হেলমেটই ব্যবহার করতে হবে মোটরসাইকেল চালানোর সময়। বিএসটিআই সার্টিফিকেশন মার্কস উইংয়ের পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, হেলমেটের মান যাচাইয়ের জন্য গত বছর আমাদের উন্নতমানের একটি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। যা দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম। এখানে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে গুণগত মান নিশ্চিত আছে কিনা সে বিষয়টি দেখভাল করে এরপর হেলমেটগুলো বাজারে ছাড়ছি। বাজারে নিম্নমানের হেলমেট থাকার কথা না। বাংলাদেশ হেলমেটের জন্য সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। আর আমদানিকৃত হেলমেটসমূহ আমরা ছাড়পত্র না দিলে কোনোভাবে বাজারে আসার কথা না। নিম্নমানের হেলমেট আমরা বাজারে আসার আগে আটকে দেই। আর বাজারে থাকা হেলমেটগুলোও আমাদের সিল দেয়া। আমরা সিল দেয়া ছাড়াও কিছু কিছু হেলমেট থাকতে পারে। আর নিম্নমানের হেলমেট যদি দেখা যায় সেগুলো হয়তোবা আমাদের ল্যাব তৈরির আগে আমদানি করা পণ্য।
নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহারকারী মোটরসাইকেল চালকরা বলছেন, নিম্নমানের এসকল হেলমেট দুর্ঘটনায় কোনো কাজে আসবে না- বিষয়টি তারাও জানে। যাত্রীরা হেলমেট ব্যবহার করতে চায় না। আবার হেলমেট ব্যবহার না করলে পুলিশের জরিমানা গুনতে হয়। তাই না পারার শর্তে তারা ওই ধরনের হেলমেট ব্যবহার করতে হয় চালকদের। তারা জানিয়েছে, এই ধরনে হেলমেট কেবলমাত্র জরিমানা ও আইনি বাধা থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করতে হয়। অন্যদিকে, হেলমেট বিক্রতারা বলছে, দোকানে বিভিন্ন দামের হেলমেট থাকলেও বাইকাররা কম দামি হেলমেটের দিকেই ঝুঁকছেন বেশি। সাধারণত দিনে যে পরিমাণ হেলমেট তারা বিক্রি করেন, তার অর্ধেক হেলমেটই কম দামি বা নিম্নমানের হেলমেট। কোথাও কোথাও ১৫০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে বিক্রীত হেলমেটগুলো মোট বিক্রীত হেলমেটের সংখ্যার অর্ধেক হচ্ছে। অর্থাৎ ক্রেতারা কিনতেই কম দামি হেলমেট বেছে নিচ্ছেন।
চায়না হেলমেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টর্কের ডিলার ইকবাল। ঢাকার ইস্কাটন এলাকায় বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে কথা হলে তিনি বলেন, বিএসটিআই বা মাননিয়ন্ত্রিত হেলমেটগুলোর দাম বেশি একটু। পাঁচ হাজার টাকারও বেশি হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মোটরসাইকেল চালকরা এক হাজার টাকা বা এর আশপাশের দামের হেলমেটগুলো ব্যবহার করে থাকে। যা হেলমেট বিক্রি হয় তার মধ্যে অন্তত অর্ধেক বিক্রি হয় ওয়ান টাইম হেলমেটগুলো। এগুলো মাটিতে পড়লেই ভেঙে যায়। বাংলামোটর এলাকার সেন্ট্রাল বাইক সার্ভিসের হেলমেট বিক্রেতা নাবিল আহমেদ বলেন, আমার দোকানে দশটা হেলমেট বিক্রি হলে অন্তত ৬ থেকে ৭টা হেলমেট বিক্রি হয় নিম্নমানের এই হেলমেটগুলো। এগুলোর দাম মাত্র দেড়শ’ থেকে সাতশ’ টাকার মধ্যে।
এলিফ্যান্ট রোডে রাইড শেয়ারের সময় রতন নামের একজন মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমরা হেলমেট কিনে কি হবে? যাত্রীরা এসব ব্যবহার করতে চায় না। বেশির ভাগ যাত্রীই হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেলে চড়ে। তারা বাইকে উঠলেই বলে হেলমেট লাগালে তাদের কারও কারও অনেক গরম লাগে, কারও কারও মাথা ব্যথা করে, কেউ বলে অনেক গরম লাগে। তাই বাধ্য হয়ে কম দামি এসব হেলমেট কিনতে হয়। এগুলো কোনোভাবে পরে থাকা যায়। মাথা ব্যথা কিংবা গরম লাগাজনিত সমস্যা হয় না। অনেকেই আছেন- যারা নিজেদের পকেটের টাকা বাঁচাতে নিম্নমানের হেলমেট কিনেন। এতে ক্ষতি যাত্রীদেরই। যদিও তারা তাদের যতটুকু দায়িত্ব তা পালন করছে, কিন্তু এটা আসলে কোনো কাজে আসে না। মগবাজার এলাকার মোটরসাইকেল চালক খোকন বলেন, কম দামি এসকল হেলমেট লাগিয়ে মূলত কোনোভাবে আইনি সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। হেলমেট না থাকলে পুলিশ ঝামেলা করে। পুলিশ কতো টাকার হেলমেট সেটা দেখে না। কিন্তু আমরাও জানি, যে কারণে হেলমেট ব্যবহার করতে বলা হয়েছে- এসকল হেলমেটে তা হচ্ছে না এবং এটা দুর্ঘটনায়ও বাঁচাতে পারবে না। কিন্তু এটাই করা লাগছে। বাংলামোটর এলাকার আরেকজন মোটরসাইকেল চালক নয়ন বলেন, হেলমেটের দাম খুব বেশি নয়। আমরা দেড় থেকে দুই লাখ টাকার গাড়ি চালাতে পারছি, পনেরোশ’ থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে একটা ভালো মানের হেলমেট কিনতেই পারি। কিন্তু একেক যাত্রী একেক রকম। তাদের মধ্যে ১০ জনের ৯ জন যাত্রীই হেলমেট চায় না।
দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, বর্তমানে মোটরসাইকেলে ব্যবহৃত হেলমেটগুলো মূলত চলকরা আইনি জটিলতা থেকে বাঁচতে ব্যবহার করেন। হেলমেট মূলত মাথার নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু এই ধরনের হেলমেট মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এটি কোনোভাবেই দুর্ঘটনায় রক্ষা করতে পারে না। ব্র্যাকের প্রশাসন এবং সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক আহমেদ নাজমুল হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, বিএসটিআই সার্টিফিকেট দেয়া হেলমেট ছাড়া বাকি সব হেলমেটই অনিরাপদ। নিম্নমানের এই সকল হেলমেট কোনোভাবেই আপদকালীন সময়ে সহযোগিতা করবে না। দেশের মানুষ বুঝে না ভালো হেলমেট কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, মোটরসাইকেলের চালক এবং আরোহী যদি মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার করে- তাহলে ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়। কিন্তু দেশের মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী কেউই মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার করেন না। চালকরা মোটামুটি মানের একটি হেলমেট ব্যবহার করলেও আরোহীরা যা পরে ওটা টুপি। বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, এখন যে হেলমেটগুলো আছে সেগুলো আসলে দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য পরে না। এসকল হেলমেট তারা শুধুমাত্র জরিমানা থেকে বাঁচার জন্য পরে থাকে। যদিও কিছু কিছু ভালো মানের হেলমেটও আছে। কিন্তু যে হেলমেট আমরা সচরাচর দেখতে পাই- সেগুলো আসলে দুর্ঘটনায় কোনোভাবেই সহযোগিতা করতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয়, যেখানে মোটরসাইকেলে শিশুসহ তিনজন বসলে মা-বাবা হেলমেট ব্যবহার করলেও সন্তানকে হেলমেট পরায় না।