
ভালুকা হবিরবাড়ী বাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু দূরেই বনবিভাগের রেঞ্জ অফিস। ২০০ গজ সামনে একটি সরু পাকা রাস্তা। অটোরিকশা চেপে দুই মিনিট গেলেই গহিন অরণ্য। সড়কের দু’পাশে হাজার হাজার গজারি, সেগুন, আকাশমনি গাছ। এক একটার আকাশছোঁয়া উচ্চতা। আশপাশে দু’একটা ঘরবাড়ি। তাও বনের জমিতে। রিকশায় চড়ে দুই কিলোমিটার যেতেই বারশ্রী গ্রাম। চারিদিকে ঘন বনভূমিতে ঘেরা গ্রামের শেষ দিকে একটি রিসোর্ট। বনের ২৫০ একর জমিতে নির্মিত রিসোর্টের একটি অংশ এই গ্রামের মধ্যে পড়েছে। বারশ্রী দেখতে নয়নাভিরাম। যেন সবুজের মাঝে এক টুকরো স্বর্গ। তবে বন উজাড় করায় গ্রামটি তার আসল সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। এখনো শত শত গাছ কেটে ঘরবাড়ি তৈরি চলছে। হরহামেশে রাতের আঁধারে বনের জমি দখল করে বাউন্ডারি নির্মাণ করা হয়। দুই যুগে বেদখল হয়েছে বনের অন্তত দেড় হাজার একর জমি। আর এই জমির অধিকাংশই দখল করেছেন ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা মো. মনিরুজ্জামান মনির।
গত ২০ বছর ধরে বিরতিহীনভাবে বনের জমি দখল করতে থাকায় এলাকায় তার নামও বদলে গেছে। মানুষ এখন তাকে বন মনির নামে চেনেন। খবর নিয়ে জানা গেছে, মনিরের দখলবাজিতে অসহায় বন বিভাগও। বারশ্রী গ্রামের আতিয়ার হোসেন মানবজমিনকে বলেন, মনির মানেই আতঙ্ক। ১৫ বছরে একরের পর একর বন খেয়েছে মনির বাহিনী। জমি দখল করে লিচু বাগান, আম বাগান করেছেন। এক সময় মনিরের নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। এখন সে শতকোটি টাকার মালিক।
মূলত বনের জমি দখল করে বিক্রি শুরু করার পরেই তার ভাগ্য বদলে যায়। প্রথমে অল্প জায়গা কিনে রাতের বেলা ৫ থেকে ১০ বিঘা নিয়ে বাউন্ডারি দিয়ে দিতেন। বন বিভাগের লোকদের সঙ্গে মনিরের সুসম্পর্ক আছে। বনের বিট অফিসার ১০টা প্লট দখল করলে একটায় বাধা দেয়। বাকিগুলো খোঁজও নেয় না। গোপন আঁতাত থাকে বলেই সাড়া দেন না। বন বিভাগ কিছু মামলা করেছে। কিন্তু কখনো তাকে ধরতে পারেনি। আবু তালেব মুন্সি নামের এক ব্যক্তি বলেন, একসময় গ্রামের ৭০ শতাংশই বনের জমি ছিল। এখন অনেক বসতবাড়ি হয়েছে। এর পেছনে মনিরের অবদান আছে। বনের জমি দখলের পরে রাতারাতি বাড়িঘর করা হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন মনির। ধীরে ধীরে কিছু জমি উদ্ধার করে বন বিভাগ পুনরায় গাছ লাগিয়েছিল। কিন্তু গাছ লাগিয়ে চলে যাওয়ার পরেই তা আবার উপড়ে ফেলা হয়। বনের যে জমি একবার দখল হয়েছে, বন বিভাগ তা আর ফেরত নিতে পারেনি। এমন নজিরও নেই। এই অঞ্চলে মনিরের চেয়ে বড় দখলবাজ আর কেউ ছিল না।
মনির জমি দখল করে কাগজপত্র তৈরি করে মানুষের কাছে বিক্রিও করেছে। বেশ কয়েকদিন ভালুকার হবিরবাড়ী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, মনিরের দখল করা জমির নব্বই শতাংশই বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেছেন। বনের জমিতে বাসা করে থাকা ভূমিহীন ব্যক্তিদের উচ্ছেদ করে সেই জমি দখলে নিতেন মনির। কেউ সরতে না চাইলে বাড়ির চারদিকে প্রাচীর দিয়ে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে অবরুদ্ধ করে রাখতেন। এভাবেই যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান বনের জমি দখল করে রাজত্ব গড়েছেন। মনির ভালুকা হবিরবাড়ী ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। গত ৫ই আগস্টের আগেও প্রতাপশালী ছিলেন। এলাকায় নিয়মিত রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করতেন। ইউনিয়নের হাজার হাজার লোক জড়ো করে মোটরসাইকেল শোডাউন দিতেন। তার নিজের একটি অনুগত বাহিনী ছিল। অল্প বয়সী তরুণদের নিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে জমি দখল করতেন। এক শতাংশ জমি কিনে বিঘা বিঘা জমি দখল ছিল তার কাছে মামুলি বিষয়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে এলাকাছাড়া। কোথায় আছেন তাও কেউ জানেন না। দখল করা সিংহভাগ জমিও বিক্রি করেছেন। ওই জমিতে বাড়িঘর, মিল কারখানা ও দোকানপাট হয়েছে। উঁচু-নিচু কিছু জমি সমতল করে চাষাবাদও করা হয়। স্থানীয়রা বলছেন, ২০০০ সালের আগেও মনিরের কোনো জমিজমা ছিল না। তিনি ভূমিহীন ছিলেন।
প্রথমদিকে মাটির ব্যবসা করতেন। পরে লাঠিয়াল বাহিনী করে তাদের মাধ্যমে বারশ্রী গ্রামে বনের এক একর জমি দখল শুরু করেন। গত ২২ বছরে পর্যায়ক্রমে একরের পর একর বনের জমি দখল করে নেন। সরজমিন গেলে বারশ্রী গ্রামের লোকজন বলেন, মনিরের নেতৃত্বে দুই যুগে বন বিভাগের ভালুকা রেঞ্জের কাদিরগর ও হবিরবাড়ী বিটের প্রায় ৯০০ একর জমি দখল করা হয়। প্রথমে রাতের আঁধারে বনে আগুন লাগিয়ে গাছ পুড়িয়ে দেয়া হতো। পরের দিনে সেই জমিতে বাউন্ডারি করা হয়। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গেল ২০ বছরে বনের জমি দখলের অভিযোগে মনিরের বিরুদ্ধে অন্তত ৩৫টি মামলা করেন বন বিভাগ। তবে এসব মামলায় তাকে কখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। মামলা হলেও আদালতে হাজিরা দিতে হয়নি মনিরের। উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। তবে ১০টি মামলা হওয়ার পর থেকে তিনি আর এলাকায় থাকেননি। পুলিশি হয়রানি এড়াতে পরিবার নিয়ে ময়মনসিংহ সদরে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। কিন্তু নিয়মিত এলাকায় এসে জমি বেচাকেনা সচল রেখেছিলেন মনির। শুধু মনিরই নয় ওই এলাকায় বনের জমি দখল ঠেকাতে পারছে না বন বিভাগ। দখলদার ও বনখেকোদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানও নিতে পারছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা-মোকদ্দমা করে দায় শেষ করছে। আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার ফলে বনের জমি দখল ও গাছ উজাড় চলমান আছে। কাদিরগড় ও মল্লিকের টেক বন বিটের বেশির ভাগ জমি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালীর দখলে চলে গেছে। অবাধে গাছ কেটে বিক্রিও করা হচ্ছে। এখানে বন বিভাগের আত্মসমর্পণই দেখছি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বন বিভাগের পক্ষ থেকে ভালুকায় বনের জমিতে গাছ লাগাতে গেলে তৎকালীন সংসদ সদস্য এম এ ওয়াহেদ প্রথমে বাধা দেন। ক্ষমতার পালাবদলের পর গাছ লাগাতে গেলে স্থানীয় লোকজন বাধা দিতে শুরু করেন। গাছ লাগানোর পর উপড়ে ফেলেন। গত ২রা সেপ্টেম্বর পাড়াগাঁও এলাকায় বন বিভাগের লোকজন গাছ লাগাতে গেলে তাদের তিন ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। শ্রমিকদের মারধর করা হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে ৫ই সেপ্টেম্বর আদালতে মামলা করেছেন। পুলিশ সেটি তদন্ত করছে। গত ২৬শে জুন কাদিগড় জাতীয় উদ্যানের জমিতে লাগানো চারা উঠিয়ে ধান লাগানো হয়। তৎকালীন এমপি ওয়াহেদের প্রভাবে একটি পক্ষ সেটি করেছে। বনের জমি দখল ও বন বিভাগের মামলার বিষয়ে জানতে মনিরুজ্জামান মনিরকে ফোন করা হলে তিনি প্রথমে এই প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান। পরে পরিচয় দেয়া হলে তিনি মনির নয় বলে ফোন কেটে দেন। পরে একাধিকবার ফোন করে ও হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা দিয়েও তার সাড়া মেলেনি।