
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজনে ঐকমত্যে পৌঁছেছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে মতবিরোধ রয়ে গেছে। এরই মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ ঘোষণা স্বাক্ষরের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোসহ বেশির ভাগ দলই নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজনের পক্ষে অনড় রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (এনসিপি) আগের অবস্থানেই রয়েছে। এরমধ্যে জামায়াত নভেম্বরে এবং এনসিপি নির্বাচনের আগে গণভোট চায়। গণভোট কখন, কীভাবে ও কি কি প্রশ্নে হবে এবং নোট অব ডিসেন্টসহ হবে কিনা- এসব বিষয়ে এখনো দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই জাতীয় নির্বাচনের দিন আলাদা ব্যালটে একই সঙ্গে গণভোটের পক্ষে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সর্বশেষ বৈঠকে বেশির ভাগ দলই এই মতামত দিয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নেয়া দলগুলোর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গণভোট নিয়ে শুরুতে কিছুটা হতাশা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আলোচনা ইতিবাচক পর্যায়ে পৌঁছেছে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাদের মতে, নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন জনমনে বিভ্রান্তি ও শঙ্কা তৈরি করতে পারে, তাই একইদিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হওয়াই সর্বোত্তম সমাধান। ওদিকে বিএনপি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনের দিনে গণভোটের পক্ষে অনড় অবস্থানে রয়েছে, সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে নভেম্বরে গণভোট চাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি সাংবিধানিক আদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্বাচনের আগে গণভোট চাইছে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ মুহূর্তে গণভোটের প্রস্তাব নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়াস। নির্বাচনের দিন গণভোটে যে ফলাফল আসবে তার আগে করলেও তাই হবে। তাই এ দাবি পরিহার করতে হবে। অধিকাংশ দল ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটের পক্ষে। বিএনপিও এ বিষয়ে একমত। সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে হাতে আছে এক থেকে দেড় মাস। এর আগে গণভোট আয়োজন করা কী সম্ভব? এটি জাতীয় নির্বাচনের মতোই কর্মযজ্ঞ। এখন গণভোট করলে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়ার প্রয়াস হিসেবেই দেখি।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, গণভোটও সুষ্ঠু হবে না। তাই গণভোট আগে হওয়াই যুক্তিযুক্ত। গণভোটের বিষয়ে সবাই একমত। নভেম্বরের মধ্যেই গণভোটটা আলাদাভাবে হয়ে যাওয়া দরকার। কিছু বিষয়ে আমাদের মতভিন্নতা থাকলেও গণভোট নিয়ে এখন আর কোনো বিরোধ নেই। জুলাই চার্টারের যে সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে, সেটি গণভোটের মাধ্যমেই গৃহীত বা বাতিল হবে।
ওদিকে গত বুধবার শেষ দিনের বৈঠকের আগে সকালে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে পাঁচটি পরামর্শ দেয় বিশেষজ্ঞ প্যানেল। তবে গণভোট নির্বাচনের আগে নাকি নির্বাচনের দিন হবে এ বিষয়ে পরামর্শ দেননি বিশেষজ্ঞরা। এই সিদ্ধান্ত তারা সরকারকে নিতে বলেছেন। গণভোট প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, নির্বাচনের দিন কয়েকটি দল, কয়েকটি দল নির্বাচনের আগেই গণভোটের কথা বলেছেন। দল ও জোটগুলোর মতামত বিবেচনা করে সুস্পষ্ট মতামত সরকারকে দেবে কমিশন। বৈঠকে যে মতামত সেগুলোকে সন্নিবেশিত করে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আরও আলোচনা করে সরকারকে পরামর্শ দেয়া হবে। আর যারা সহযোগিতা করেছে সকলকে সেসব বিষয়ে অবহিত করা হবে।
বৈঠকে অংশ নেয়া কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে জনগণের সরাসরি মতামত নেয়া হলে জাতীয় ঐকমত্য প্রক্রিয়াটি আরও শক্তিশালী হবে। যদিও এ নিয়ে আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তবে রাজনৈতিকভাবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, কমিশন সরকারকে একটি প্রস্তাব পাঠাবে। নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট একটি আদেশ বলে বা প্রজ্ঞাপন আকারে পাঠাবে। কমিশন দু’-তিনটি প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠাবে। সরকার গণভোটসহ সনদের কার্যকরী দিক পরীক্ষা করে সরকার একটি আদেশ জারি করবেন।
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, গণভোটের বিপক্ষে ছিলাম আমরা। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে গণভোট হলে সেটা নির্বাচনের দিন হতে পারে। বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়গুলোতে গণভোট হলো, কিন্তু নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো কীভাবে জনগণের কাছে নিয়ে গণভোট করা হবে। একটি বিষয় গণভোট হলে জনমত সহজ হতে পারে। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডার উপরে, ভিন্ন ভিন্ন দলের মতামত এগুলো আলাদা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমরা মনে করি না।
অন্যদিকে গণফোরাম, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), বাংলাদেশ জাসদ, গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ পার্টি এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশসহ অধিকাংশ দল নির্বাচনের দিনই গণভোট চায়। তবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই গণভোট আয়োজনের পক্ষে অবস্থানে রয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই গণভোট আয়োজন করতে হবে। এ ছাড়া আলোচনার সারসংক্ষেপ ও সুপারিশ আকারে কয়েকটি প্রস্তাব শিগগিরই সরকারকে ঐকমত্য কমিশন দেবে- সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু মানবজমিনকে বলেন, ঐকমত্য কমিশন যদি গণভোট আগেও করতে পারে আমাদের সমস্যা নেই। তবে আমাদের মত হচ্ছে নির্বাচনের দিন গণভোট হলে ভালো হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, দু’-একটি দল ছাড়া বেশির ভাগ দলই চাইছে জাতীয় নির্বাচনের দিন জুলাই জাতীয় সনদের উপর গণভোট আয়োজন হোক। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নামে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে। সেই প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই গণভোট হবে। একটি দল দাবি করতেই পারে। কিন্তু হাতে সময় চার মাস। গণভোট জাতীয় নির্বাচনের মতোই। এ সময়ের মধ্যে কি নির্বাচন করা সম্ভব?
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল কাফী রতন মানবজমিনকে বলেন, জনগণের অভিপ্রায় জানার জন্য জনমত যাচাই করতে পারেন। এটা দিয়ে আপনি হয়তো নৈতিক চাপ তৈরি করতে পারবেন। কিন্তু আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা করতে পারবেন না। আমরা বলেছি, এটা একটি অপ্রয়োজনীয় এক্সারসাইজ। তবে গণভোট হলে নির্বাচনের দিনই আয়োজন করা হোক।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, কমিশন জানিয়েছে, একটি প্রস্তাবনা আকারে তারা সরকারকে দেবে। সে বিষয়ে দলগুলোকেও অবগত করা হবে। প্রস্তাবনায় গণভোটের প্রশ্নটি কী হবে, এটা গুরুত্বপূর্ণ। গণভোটের সঙ্গে নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো কীভাবে সমাধান করা হবে। কমিশনের প্রস্তাবনা দেখে আমরা দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নেবো।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী মানবজমিনকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোটের আয়োজন করা হোক। নির্বাচনের আগে গণভোট হলে জনমনে শঙ্কা রয়ে যাবে। নানা দিক বিবেচনা করে আমরা মনে করি ভোটের দিন গণভোট আয়োজন করা অধিকতর নিরাপদ।