
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একক প্রার্থী বাছাইয়ে কাজ করছে বিএনপি। তফশিলের আগেই ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ আসনে একক প্রার্থীকে মাঠে কাজ করার জন্য ‘সবুজ সংকেত’ দিতে চায় দলটি। বিএনপির তৃণমূল নেতাদের শঙ্কা, দ্রুত আসনভিত্তিক একক প্রার্থীকে ‘সবুজ সংকেত’ না দিলে অনেক জায়গায় দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং বাড়তে পারে। নেতাদের মতে, বেশির ভাগ আসনে একাধিক প্রার্থী থাকায় নেতাকর্মীরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছেন। এমন আসনও আছে, যেখানে বাবা-ছেলে এবং ভাই-বোন আলাদাভাবে গণসংযোগ করছেন। এ অবস্থায় এখনই প্রতি আসনে একক প্রার্থী নির্বাচনি মাঠে নামাতে পারলে বিবাদ-গ্রুপিং এড়ানো যাবে। তাই যত দ্রুত দল থেকে একক প্রার্থীকে ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়া হবে, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ততই বেশি সুসংগঠিতভাবে নির্বাচনি মাঠে নামতে পারবেন। অন্তত ২৫টি নির্বাচনি আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী এবং ১০টি জেলার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘ বছর দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আসনভিত্তিক মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক নেতা। ইতোমধ্যে যেসব আসনে বেশি প্রার্থী বা জটিলতা বেশি, সেসব আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের গুলশান কার্যালয়ে ডেকে নানা দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। দলের হাইকমান্ডের স্পষ্ট বার্তা-ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনি মাঠে থাকতে হবে। কেন্দ্র থেকে একক প্রার্থীকে ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়া হলে অন্য যারা মনোনয়নপ্রত্যাশী, তারা ওই একক প্রার্থীকে সমর্থন করে ঐক্যবদ্ধভাবে গণসংযোগ করবেন। যারা এ নির্দেশনা মানবেন না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দলটির নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, এবার একক প্রার্থী নির্ধারণে বেশ কয়েকটি মানদণ্ড দেখা হচ্ছে। আবার যেসব আসনে দুই বা ততোধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী আছেন, নিজ এলাকায় তাদের সবাই জনপ্রিয়-এমন ক্ষেত্রে একক প্রার্থী ঠিক করা একটু কঠিন হতে পারে। সেক্ষেত্রে একজনকে ‘সবুজ সংকেত’ দিয়ে বাকিদেরও ক্ষমতায় গেলে যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে-এমনটা সিদ্ধান্ত রয়েছে। সুতরাং একক প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব বেশি অসুবিধা হবে না বলে নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন।
সম্প্রতি দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, শিগ্গিরই আসনভিত্তিক একক প্রার্থীকে মাঠে কাজ করার জন্য আমরা গ্রিন সিগন্যাল (সবুজ সংকেত) দেব। তবে সেটা চূড়ান্ত নয়। তফশিল ঘোষণার পর পার্লামেন্টারি বোর্ডের মাধ্যমে আমরা চূড়ান্ত মনোনয়ন দেব। তিনি এও বলেন, প্রতিটি আসনে আমাদের একাধিক যোগ্য প্রার্থী আছেন। অনেক আসনে আমাদের পাঁচজন, সাতজন এবং দশজন করে যোগ্য প্রার্থী আছেন। সুতরাং একটা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়টি আমাদের দেখতে হচ্ছে।
দলীয় সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের প্রক্রিয়াটি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই দেখভাল করছেন। ইতোমধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটি তার ওপর এই দায়িত্ব দিয়েছে। তবে আগামী দিনে দলীয় মনোনয়ন কারা পাবেন, সে সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, কোনো একটি পার্টিকুলার এলাকা থেকে দলের এমন একজন ব্যক্তিকেই নমিনেশন দিতে চাইব, যিনি ওই এলাকার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন আছেন। যার সঙ্গে ওই এলাকার মানুষের সম্পৃক্ততা আছে, ওঠাবসা আছে, মানুষের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম। যার সঙ্গে ওই এলাকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, তরুণ, নারী, মুরুব্বিসহ ছাত্র-ছাত্রী সবার যোগাযোগ আছে। এ ধরনের মানুষকেই আমরা অগ্রাধিকার দেব।
জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আগামী নির্বাচনের জন্য বিএনপি পুরোপুরি প্রস্তুত। একক প্রার্থীর তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। কবে নাগাদ সম্ভাব্য প্রার্থীদের সবুজ সংকেত দেওয়া হবে, সেটা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে শিগ্গিরই সিদ্ধান্ত নেবেন।
এদিকে মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও প্রার্থীর তালিকা চেয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। বেশির ভাগ মিত্র দল ইতোমধ্যে তাদের প্রার্থী তালিকা দিয়েছে। তবে মিত্রদের ঠিক কতটি আসনে ছাড় দেবে, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএনপি।
তৃণমূল নেতারা জানান, জামায়াতে ইসলামীসহ অনেক রাজনৈতিক দলই একক প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। এমনকি তারা নিজ নিজ আসনেও গণসংযোগ করছেন। কিন্তু প্রায় প্রতিটি আসনে বিএনপির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী এখন মাঠে রয়েছেন। তাদের অনেকেই বিগত সময়ে দলের জন্য অবদান রেখেছেন। এ অবস্থায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও দ্বিধায় আছেন, বাড়ছে গ্রুপিংও। কে পাচ্ছেন দলীয় মনোনয়ন, এ নিয়ে তাদের এখন বেশি আগ্রহ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাটোরের একটি আসনে ভাই-বোন মনোনয়ন চাচ্ছেন। তারা পৃথকভাবে গণসংযোগও করছেন। এমন চিত্র আরও কয়েকটি আসনে রয়েছে। আবার এরকমও আছে-একই আসনে বাবা-ছেলে দুজনই মনোনয়ন চান। তবে বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে বলেন, এবারের নির্বাচনে কাউকে দুটি আসন বা কোনো পরিবারকে দুটি আসন দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে এ ধরনের যেসব আসন রয়েছে, সেখানে ওই পরিবারকেই সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে কে হবেন প্রার্থী।
বরিশাল-৫ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, এখন বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চান দ্রুত একক প্রার্থীর তালিকা ঘোষণা করা হোক। তাহলে তারা সংঘবদ্ধভাবে দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে মাঠে নামতে পারেন। এখন বিএনপি যাত্রা শুরু করলে ওরা (জামায়াতসহ বিভিন্ন দল) প্রচার-প্রচারণার গতিতে পিছিয়ে যাবে। বিএনপি একটা বড় রাজনৈতিক দল। এখানে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নয়, প্রতিযোগিতা চলে। দ্বন্দ্ব হিসাবে যারা দেখেন, তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। এই প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যিনি তৃণমূল নেতাকর্মীর মন জয় করতে পারবেন, তিনিই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবেন। যত যাই হোক, নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ ঠিকই ধানের শীষে ভোট দেবে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু নির্বাচন করতে চান নাটোর-২ আসন থেকে। এর আগে এ আসন থেকে তিনি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুলু যুগান্তরকে বলেন, তৃণমূলের চাওয়াই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের চাওয়া। জনমত যাচাই-বাছাই করেই তো দলের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেবেন। বিএনপি একটা বড় দল, এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যাও অনেক। জনপ্রিয়তাও কেউ কারও চেয়ে কম না। এখন কথা হচ্ছে-জনগণ কাকে চায়, এর ভিত্তিতেই দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তৃণমূল তার জন্য কাজ করবে।
চট্টগ্রাম-১৬ আসনের ধানের শীষের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক ছাত্রনেতা মফিজুর রহমান আশিক বলেন, বিগত দিনের আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে ছিলাম। আমাকে গুম করা হয়েছিল। অনেকবার জেল খেটেছি। জুলাই আন্দোলনেও রাজপথে সামনের সারিতে ছিলাম। বাঁশখালীতে দীর্ঘদিন নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাজ করছি। প্রার্থী করার ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যেটি ভালো মনে করবেন, সেটিই আমাদের কাছে চূড়ান্ত।
ভোলা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রাইসুল আলম বলেন, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা দলীয় একক প্রার্থীর অপেক্ষায় আছেন। দল থেকে যাকে মনোনয়ন দেবে, নেতাকর্মীরা তার পক্ষেই কাজ করবে। এখন গ্রুপিং আছে। তবে প্রার্থী ঘোষণা হলে সেটি থাকবে না।