
একক প্রার্থী নিয়ে ছুটছে জামায়াত। ছুটছেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও। টার্গেট একটাই-‘স্বরূপকাঠি দখল’। তিন উপজেলার মধ্যে যেন এই একটি উপজেলার ভোট ম্যানেজ হলেই যাওয়া যাবে সংসদে। যার নেপথ্য কারণ-বেশি ভোটারের বসবাস। পিরোজপুর-২ নির্বাচনি এলাকার (ভাণ্ডারিয়া-কাউখালী-স্বরূপকাঠি) সবচেয়ে বেশি ভোটারের বসবাস এখানে, যা বাকি দুই উপজেলার মোট ভোটের সমান। এরই মধ্যে এই আসনে চূড়ান্ত হয়ে গেছে জামায়াতের প্রার্থী। মরহুম মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামিম সাঈদীকে মনোনয়ন দিয়েছে তারা। একক প্রার্থী হিসাবে তিনি চষে বেড়াচ্ছেন স্বরূপকাঠি। সপ্তাহে সপ্তাহে করছেন গণসংযোগ-সমাবেশ। এর বিপরীতে দ্বন্দ্ব-কোন্দলে ৫ খণ্ড হয়ে আছে উপজেলা বিএনপি। স্বরূপকাঠিরই ৩ জন চাইছেন মনোনয়ন। সঙ্গে আছেন ভাণ্ডারিয়ার আরও দুজন। প্রত্যেকেরই রয়েছে ছোট-বড় বলয়। যে বলয়ে ৫ ভাগ দলের নেতাকর্মীরা। সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি স্বরূপকাঠির ৩ গ্রুপে। দ্বন্দ্ব-কোন্দলে যেন বন্ধ একে অপরের মুখ দেখাদেখি। পরিস্থিতি এমন যে স্বরূপকাঠির ভোটে ভর করতে গিয়ে হয়তো হিতে-বিপরীত হতে পারে বিএনপির। যার ফসল যাবে জামায়াতের ঘরে।
৯০-পরবর্তী কোনো নির্বাচনেই এখানে জেতেনি ধানের শীষ। সেই আসনেরই উপজেলা স্বরূপকাঠি। কাগজে-কলমে নেছারাবাদ হলেও আদি নামেই উপজেলাটিকে চেনে সবাই। নির্বাচন এলেই আলোচনা শুরু হয় এই উপজেলা নিয়ে। এর কারণ, এখানে থাকা প্রায় ২ লাখ ভোটার। যদিও মাত্র একবার দেখা গেছে সেই বেশি ভোটের ক্যারিশমা। ২০০৮ সালে সংসদ-সদস্য হয়েছিলেন স্বরূপকাঠির শাহ আলম। বাকি ছয়বারের পাঁচবার সংসদ-সদস্য হন জেপির (মঞ্জু) চেয়ারম্যান ভাণ্ডারিয়ার আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। ২০২৪ সালে সংসদ-সদস্য হওয়া মহারাজের বাড়িও ভাণ্ডারিয়া উপজেলায়। এসব ইতিহাস সত্ত্বেও আবার শুরু হয়েছে স্বরূপকাঠি দখলের যুদ্ধ। যে যুদ্ধে এবার মুখোমুখি বিএনপি আর জামায়াতে ইসলামী। এক্ষেত্রে নির্বাচনি এলাকার লোক না হয়েও সাঈদীপুত্র হিসাবে খানিকটা সুবিধায় আছেন শামিম। ৬/৭ মাস ধরে চলছে তার প্রচার-প্রচারণা। প্রায়ই যাচ্ছেন স্বরূপকাঠি। উপজেলা-পৌর-ইউনিয়ন-ওয়ার্ড এমনকি কেন্দ্র কমিটি পর্যন্ত রয়েছে তাদের। বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। চলছে ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা।
জামায়াত যখন ব্যস্ত স্বরূপকাঠি দখলে, ঠিক তখনই অন্তর্দ্বন্দ্ব-কোন্দলে খণ্ড খণ্ড বিএনপি। একসময় এখানে দুই ধারায় বিভক্ত ছিল দলটি। এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিতেন সাবেক উপজেলা আহ্বায়ক ওয়াহিদুজ্জামান। অপরপক্ষে ছিলেন সাবেক সভাপতি ফখরুল আলম। ফ্যাসিস্ট আমলে এ দুইজনের বিরুদ্ধে ওঠে আওয়ামী তোষণের অভিযোগ। আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ-সদস্য একেএমএ আউয়ালের ছোট ভাই মহারাজ বিয়ে করেন ফখরুলের বোনকে। যে কারণে ফ্যাসিস্ট আমলে তেমন একটা অত্যাচার-নির্যাতন সইতে হয়নি তাকে। সংসদ-সদস্য বেয়াইয়ের সূত্রে ছিলেন বহাল তবিয়তে। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম আর সাবেক সংসদ-সদস্য অধ্যক্ষ শাহ আলমের সঙ্গেও ছিল তার যোগাযোগ, সখ্য। ওয়াহিদের বিরুদ্ধেও ছিল ফ্যাসিস্ট দলের নেতাদের সঙ্গে সখ্য থাকার অভিযোগ। আওয়ামী লীগকে হারিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পর ওই অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। দুই নেতার এই দ্বন্দ্বের মধ্যে তৈরি হয় তৃতীয় গ্রুপ। যে গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক সদস্য সচিব আলবেরুনী সৈকত। এই সৈকত একসময় ছিলেন ফখরুলের সঙ্গে। ৫ আগস্টের আগে দীর্ঘ সময় এলাকায় ফখরুলের অনুপস্থিতির সুযোগে অবস্থান শক্ত করেন তিনি। গড়ে তোলেন নিজস্ব অনুসারীদের আলাদা বলয়। সাম্প্রতিক সময়ে আরও কিছু ঘটনা ঘটে স্বরূপকাঠিতে। আওয়ামী সম্পৃক্ততার অভিযোগে কমিটি ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি ১ বছরের জন্য পদ-পদবি স্থগিত করা হয় ওয়াহিদুজ্জামানের। যদিও এই সিদ্ধান্তকে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের ফল বলছেন ওয়াহিদ। মনোনয়নের লড়াই থেকে সরাতে এটা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তার। এক্ষেত্রে তার অভিযোগ ফখরুলের দিকে। যদিও তা মানতে নারাজ ফখরুল। কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে সব হয়েছে, বলেন তিনি। সেই সঙ্গে অস্বীকার করেন ফ্যাসিস্ট দলের নেতাদের সঙ্গে কোনোরকম ঘনিষ্ঠতার কথা।
অভ্যন্তরীণ কোন্দলে স্বরূপকাঠি বিএনপির এই খণ্ডবিখণ্ড অবস্থার সুযোগে সেখানে ঢুকে পড়েছেন বিএনপির অন্য দুই মনোনয়ন প্রার্থী মাহমুদ হোসাইন ভিপি মাহমুদ এবং সুমন মঞ্জুর। তাদের দুজনের বাড়ি ভাণ্ডারিয়া উপজেলায়। সুমন উপজেলা বিএনপির সভাপতি। কিংবদন্তি সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ভাতিজা ভিপি মাহমুদ ভাণ্ডারিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি। যদিও এখন পর্যন্ত স্বরূপকাঠিতে বড় ধরনের কোনো সভা-সমাবেশ-শোডাউন করতে পারেননি সুমন। তবে ভিপি মাহমুদের এখানে রয়েছে শক্ত অবস্থান। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিশাল মিছিল আর সম্প্রতি বিপুলসংখ্যক ট্রলার নিয়ে করেছেন নৌ র্যালি। স্থানীয় পূজামণ্ডপগুলোয় দিয়েছেন অর্থ সহায়তা। স্বরূপকাঠির নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ আছেন তার সঙ্গে। উপজেলা বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী বলেন, ‘ওয়াহিদ, সৈকত আর ফখরুলের দ্বন্দ্বই সুযোগ করে দিয়েছে মাহমুদকে। তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে অবস্থান শক্ত করেছেন তিনি। যে কারণে বলা যায়, এখানে এখন ৫ খণ্ড দল।’ যদিও এই ৫ জনের মধ্যে মঙ্গলবার ৩ জনকে ঢাকায় ডেকে নেয় বিএনপি। মনোনয়নপ্রার্থী হিসাবে কেন্দ্রের ডাক পাওয়া এই ৩ জন হলেন ভিপি মাহমুদ, ফখরুল আলম ও আলবেরুনী সৈকত। এখানে আরও যে বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে তা হলো, স্বরূপকাঠির যারা মনোনয়ন চাইছেন, তাদের সবার রাজনীতি কেবল স্বরূপকাঠিনির্ভর। কাউখালী-ভাণ্ডারিয়ায় নেই তেমন পরিচিতি। যোগাযোগ নেই ওই দুই উপজেলার মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। অন্যদিকে মাহমুদসহ অন্যরা কাজ করেন সব উপজেলা নিয়ে।
বেশি ভোটের হিসাব কষে স্বরূপকাঠির কাউকে মনোনয়ন দিলে কী হতে পারে জানতে চাইলে উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে জনসম্পৃক্ততা। আওয়ামী দুঃশাসনের সময় এলাকায় না থাকা কেউ যদি ৫ আগস্টের পর এসে মনোনয়ন পান, তাহলে দলের নেতাকর্মীরা তার পক্ষে কতটুকু কাজ করবে, সেটাও চিন্তা করতে হবে।’ কাউখালী উপজেলা বিএনপির সভাপতি আহসান কবির বলেন, ‘বেশি ভোটের এলাকা দেখে সেখানকার কাউকে মনোনয়ন দিলেই যে তিনি জিতেন, তা ঠিক নয়। দেখতে হবে বাকি দুই উপজেলায় তার কী অবস্থান। স্বরূপকাঠিতে যেমন বেশি ভোট, তেমনই ভাণ্ডারিয়া আর কাউখালী মিলিয়ে কিন্তু দুই লাখের বেশি ভোটার রয়েছে। যে নেতা ৩ উপজেলায়ই জনপ্রিয়, নেতাকর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে-এমন কাউকে মনোনয়ন দেওয়া উচিত।’
ভাণ্ডারিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক জালাল সিকদার বলেন, ‘ভোটাররা এখন অনেক বেশি সচেতন। বিপদের সময় কাকে কাছে পাওয়া গেছে, ৫ আগস্টের আগে কারা এলাকায় ছিলেন, বসন্তের কোকিল হয়ে কারা এখন মনোনয়ন চাইছেন-সবকিছুই তারা হিসাব করেন। বেশি ভোটের এলাকা থেকে প্রার্থী দেওয়া হলেই যদি সংসদ-সদস্য হতেন, তাহলে ৭টি নির্বাচনের ৬টিতেই কেন ভাণ্ডারিয়া থেকে হলো?’
বেশি ভোটের এলাকা হিসাব করে স্বরূপকাঠির কাউকে যদি প্রার্থী করে বিএনপি, সেক্ষেত্রে জামায়াতের অবস্থান কী হতে পারে জানতে চাইলে স্বরূপকাঠি উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এদেশের মানুষের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। তার পুত্র এখানে সংসদ-সদস্য প্রার্থী। ভোটের ঘাঁটি কিংবা বেশি ভোটের হিসাবগুলো তো বহু পুরোনো। আগামী নির্বাচনে মানুষ দল নয়, ব্যক্তি দেখে ভোট দেবে। ভোট আসুক, তখনই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’ উপজেলায় বিএনপির একাধিক গ্রুপের কথা স্বীকার করে ফখরুল আলম বলেন, ‘মনোনয়ন ঘোষণা হয়ে গেলে সমস্যা থাকবে না। সবাই একযোগে ধানের শীষের পক্ষে মাঠে নামবে।’ ভিপি মাহমুদ বলেন, ‘কোনো এলাকাই কারও একার নয়। সবাই আমরা বিএনপির। ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমান যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই মাথা পেতে নেব।’