
গণভোট (রেফারেন্ডাম) আয়োজন করতে কী ধরনের প্রস্তুতি দরকার-তা খতিয়ে দেখতে কর্মকর্তাদের অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অথবা পৃথক দিনে আয়োজন করলে কত টাকা ব্যয় হবে, সে হিসাবও তৈরি করতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনার পর এ সংক্রান্ত কাজ এগিয়ে রাখতে তারা একমত হন। বৈঠকে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, শাপলা প্রতীক চেয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অনড় অবস্থানে ইসির করণীয়সহ বেশকিছু বিষয় নিয়েও তারা কথা বলেন। এর একপর্যায়ে গণভোটের প্রস্তুতির বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা। এরপরই নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে অনানুষ্ঠানিকভাবে এসব কাজ এগিয়ে রাখতে বলা হয়। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান আলোচনার মধ্যে এ পদক্ষেপ নিল ইসি। বৈঠক শেষে দুজন নির্বাচন কমিশনার যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জানা যায়, গণভোট আয়োজনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য চলাবস্থায় নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত থাকবে। ইসি এ নিয়ে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিতর্কে জড়াতে চায় না। এই সময়ে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যাতে আস্থার সংকট তৈরি হয়। তবে প্রস্তুতির প্রাথমিক কাজ ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলোর তথ্য ইসি জানতে চায়। সরকারের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর গণভোট আয়োজনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি শুরু করবে তারা। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন পাশ হয়েছে। ওই আইনে গণভোট আয়োজনের এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া আছে।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘গণভোট আয়োজন নিয়ে সরকার থেকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি। সরকারের সিদ্ধান্ত পেলে সেই অনুযায়ী আমরা পদক্ষেপ নেব। তবে একথা সত্য যে, এ নির্বাচন আয়োজন করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো গণভোটে একমত হয়েছে। তবে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একদিনে নাকি একাধিক দিনে অনুষ্ঠিত হবে-তা নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা চলছে। বুধবার ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে পৃথক ব্যালটে গণভোট দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট করার পক্ষে মত দিয়েছে। কমিশন মনে করে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের জন্য ত্রয়োদশ সংসদকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষমতা প্রদান করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যত ঐকমত্য রয়েছে।
ইসির বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক আলোচনায় বোঝা যাচ্ছে, দেশ একটি গণভোটের দিকে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণভোট হয়। তখন হ্যাঁ বা না ভোট দেন ভোটাররা। এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে গণভোট হতে যাচ্ছে। এমনকি গণভোটের প্যাটার্নও ভিন্ন ধরনের। গণভোটে একাধিক বিষয়ে ভোট দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এই ভোট আয়োজন করতে হলে পৃথক আইন ও বিধিমালা প্রণয়নসহ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যেসব প্রস্তুতি দরকার, সেইসব প্রস্তুতিই নিতে হবে। তারা বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শাপলা প্রতীক নিয়ে জটিলতা, প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ, সীমানা নির্ধারণ নিয়ে আদালতে আইনি লড়াইসহ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করতে হিমশিম খাচ্ছে ইসি। এর মধ্যে গণভোট আয়োজনের জন্য যে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে, তা কমিশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী নেওয়াজ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাজ নির্বাচন করা। আইন অনুযায়ী সব ধরনের নির্বাচন করতে পারব। তবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সময় দিতে হবে।
গণভোট আয়োজন করতে সরকারি আদেশ জারি, আইন ও বিধিমালা প্রণয়নসহ বড় ধরনের প্রস্তুতির দরকার হবে বলে জানান নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী। ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালের গণভোট আয়োজনে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রতিটি গণভোট আয়োজনে পৃথক পৃথক আইনের দরকার হয়। এছাড়া সরকারি আদেশ নাকি অন্য কোনো আইনি পন্থায় গণভোট হবে তা সরকারকে ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, প্রস্তুতিমূলক কাজ ইসি করবে। গণভোটে একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলায় জেলায় সহকারী রিটার্নিং এবং বিপুলসংখ্যক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ এবং তাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। জাতীয় সংসদ ও গণভোট একই দিনে করলে দুই ভোটের জন্য পৃথক ব্যালট পেপার ছাপা, পৃথক ব্যালট বাক্স সরবরাহ এবং ভোট গণনার জন্য পৃথক টিমের দরকার হবে। আর একাধিক দিনে সংসদ ও গণভোট করা হলে একই কাজ দুবার করতে হবে, ব্যয়ও বেশি হবে। সুতরাং একদিনে বা একাধিক দিনে এ দুটি নির্বাচন হোক না কেন- তা আয়োজন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন তিনি।
যেসব প্রস্তুতি নিতে হবে ইসির : ইসির কর্মকর্তারা জানান, অল্প সময়ের মধ্যে গণভোট আয়োজন করা ইসির বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। গণভোটের ব্যালট পেপারে নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো উল্লেখ থাকলে, সেই বিষয়ে ইসিকে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। এ পদ্ধতির ভোটে একজন ভোটারের ভোট দিতে সময় বেশি লাগবে। ওই বিষয়টি বিবেচনা করে ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তারা আরও জানান, বর্তমানে প্রতি ৫০০ জন নারী ও ৬০০ জন পুরুষের জন্য একটি কক্ষ নির্ধারণ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এতে খসড়া তালিকায় ৪২ হাজার ৬১৮টি ভোটকেন্দ্র ও দুই লাখ ৪৪ হাজার ৪৬টি ভোটকক্ষ রয়েছে। গণভোট করতে হলে ভোটকেন্দ্র ও কক্ষের সংখ্যা অনেক বেশি বাড়াতে হবে। ফলে ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ নির্ধারণের কাজটি আবারও করতে হবে ইসিকে।
এছাড়া গণভোট আয়োজন করতে জাতীয় নির্বাচনের দ্বিগুণ ব্যালট এবং বিভিন্ন ধরনের প্যাকেট মুদ্রণ করতে হবে, যা ইসির জন্য আরেক চ্যালেঞ্জ। সামনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বই ছাপার কাজ চলবে। পাশাপাশি প্রায় ১৩ কোটি ভোটারের জন্য ২৬ কোটি (সংসদ নির্বাচনের ১৩ কোটি ও গণভোটের ১৩ কোটি) ব্যালট পেপার ছাপতে হবে। এরজন্য বিপুল পরিমাণের কাগজ সংগ্রহ করতে হবে। সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি গণভোট করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যাও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি গণভোটের জন্য বিভিন্ন নির্বাচনি মালামাল কিনতে হবে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় এসব মালামাল কেনা সময়সাপেক্ষ। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এসব মালামাল সংগ্রহ করতে গেলেও সময়ের প্রয়োজন হবে। এসব মালামালের ব্যবস্থাপনার জন্য বাড়তি জনবলের প্রয়োজন হবে। এছাড়া ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের বাড়তি প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন হবে। তারা আরও জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট পৃথক দিনে করা হলে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে।