Image description
গুমসংক্রান্ত কমিশনের তথ্যচিত্র

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে শত শত মানুষ গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় বাংলাদেশের প্রত্যেকটা বাহিনী জড়িত। তবে এদের মধ্যে মূল ভূমিকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছয়টি ইউনিট। সেগুলো হলো-র‌্যাব, বাংলাদেশ পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি, ডিজিএফআই ও এনএসআই। এসব বাহিনীর সদস্যদের তত্ত্বাবধানে গুমের শিকার ব্যক্তিদের দিনের পর দিন আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। তাদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। প্রথমদিকে গুমের পর হত্যা করে লাশ রাস্তাঘাটে ফেলা হলেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে লাশ গুম করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হত্যার পর লাশ ফেলা হয় নদীতে। এসব অপকর্মের পুরস্কার হিসাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। গত বছরের পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতনের পর ওইসব বাহিনীর অভিযুক্ত অনেক কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে পালালেও এখনো অনেকে বহাল তবিয়েত আছেন। এদিকে এসব গুম ও হত্যার সবকিছু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই হয়েছে বলে মনে করছে গুম কমিশন।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুমের শিকার ব্যক্তিদের নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনার তথ্যচিত্র বুধবার রাতে প্রকাশ করেছে গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি। সূত্র বলছে, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৪২ কর্মকর্তার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়। জানুয়ারি মাসে এদের বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পরোয়ানা বের হওয়ার সময় অনেকে দেশে ছিলেন। কিন্তু পাসপোর্ট না থাকা সত্ত্বেও গ্রেফতারি পরোয়ানা বের হওয়ার পরপরই অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত কমিশনে জমা পড়া ১৮০০ অভিযোগের মধ্যে ২৫০টির অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। এদের মধ্যে বিভিন্ন পেশাজীবী ও শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে। গুমের শিকার অনেকের রাজনৈতিক পরিচয়ও মিলেছে। তাদের জঙ্গি ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে তথ্যচিত্রে গুম কমিশনের সদস্য নুর খান বলেছেন, ‘আমাদের কাছে যারা মুখ খুলেছেন এটাই গুমের পূর্ণাঙ্গ তথ্য নয়। এর কয়েক গুণ বেশি এখনো সমাজে রয়েছেন, যারা সাহস পাচ্ছেন না জনসম্মুখে অভিযোগ করতে।

কমিশনের সদস্যরা জানিয়েছেন, তদন্তে নেমে তারা দেখতে পেয়েছেন ৫ আগস্টের পরই অধিকাংশ আলামত ধ্বংস করা হয়েছে। এমনকি যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল সেসব বন্দিশালার অবকাঠামো ধ্বংস বা পরিবর্তন করা হয়েছে।

তথ্যচিত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘যদি এই কমিশন না থাকত তবে সবই হয়তো গল্পের মতো মনে হতো। কেউ বলত হ্যাঁ, কেউ বলত না। কিন্তু এখন তাদের হাতে (গুমসংক্রান্ত কমিশন) সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে। এখন আমরা ন্যায়বিচারের দিকে এগোব।’

তথ্যচিত্র সূত্রে দেখা গেছে, গত বছরের ২৭ আগস্ট গুম কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এক ভুক্তভোগী বলেছেন, তিনি একটি বাহিনীর সদস্যকে বলেছিলেন, ‘আপনি নিজেও তো দেখতেছেন তারা (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) অস্ত্র দিয়ে নাটক সাজাইতাছে। এতে ওনাদের লাভ কী। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই সদস্য বলেন, আপনারা চলে যাবেন, এরপরই স্যারের প্রমোশন হবে, এটাই লাভ। গুমের শিকারে ভুক্তভোগী তখন বলেন, একটা প্রমোশনের জন্য আমার জীবনডারে ধ্বংস করে দিল। র‌্যাব গোয়েন্দা শাখায় ২৯১৯ দিন বন্দি থাকা ব্যারিস্টার আরমান (জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম আরমান) বলেন, যে স্থানে আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল সেখানে সব বন্দিকে ২৪ ঘণ্টা চোখ ও হাত বেঁধে রাখা হতো। কোথায় আছি, কয় তারিখ বলা হতো না। সময়টাও বলত না। আমি বারবার তাদের কাছে নামাজ পড়ার জন্য সময় জানতে চাইতাম-কীভাবে নামাজ পড়ব। তারা বলত-বলা যাবে না, ওপরের আদেশ আছে।

গুমসংক্রান্ত কমিশনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গুমের পর ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে অনেককেই। তাদের মধ্যে কারও কারও জেলে যেতে হয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারত সরকারের কাছে বাংলাদেশি বন্দি যারা আছে তাদের তালিকা চেয়েছিল গুমসংক্রান্ত কমিশন। কিন্তু তারা যে তালিকা দিয়েছে সেটি অসম্পূর্ণ এবং যে সময়ের অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪-এর ৫ আগস্ট পর্যন্ত তথ্য চাওয়া হলেও সেই সময়ের তালিকা ভারত দেয়নি।

অনুসন্ধানে কমিশন জানতে পেরেছে, গুমের শিকার কারও কারও ক্ষেত্রে চরম পরিণতি হয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশকে বেশ কিছুদিন জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বা কয়েকদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে হত্যা করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। যখন ক্রসফায়ার আন্তর্জাতিকভাবে বেশি সমালোচিত হচ্ছিল তখন সিদ্ধান্ত নেয় লাশ ধ্বংস করে দেবে। পরে সমালোচনার মুখে নৌকায় করে নদীতে নিয়ে গুলি করে মেরে লাশ ভারী বস্তায় বেঁধে পানিতে ফেলা হতো।

তৎকালীন র‌্যাবে সংযুক্ত সামরিক বাহিনীর এক সদস্য তথ্যচিত্রে বলেছেন, হত্যার উদ্দেশ্যে নৌকায় করে নিয়ে যাওয়ার সময় সিনিয়র কর্মকর্তারা গন্তব্য সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতেন না। শুধু বলতেন সাউথের (দক্ষিণ) দিকে যাব। যাওয়ার পথে স্লো ডাউন বললেই বুঝতাম এখন হত্যা প্রক্রিয়া শুরু হবে। ট্রলারের খোলের ভেতর থেকে তাকে (ভুক্তভোগী) তুলে নিয়ে এসে সিমেন্টের বস্তা দিয়ে হাঁটু বরাবর বাঁধা হতো।

তিনি আরও বলেন, স্যারের পছন্দের জায়গা ছিল মাথায় গুলি করা। এক রাউন্ডেই মেরে ফেলত। কখনো যদি স্যারের মনে হতো হাত কাঁপছে তখন বলত সেকেন্ড শট। এই হত্যার জন্য জিয়াউল আহসানের টিম সুন্দরবনের দস্যুদের থেকে উদ্ধার করা একটা ট্রলার এনেছিল।

এছাড়া বিষপ্রয়োগ করেও মারা হতো। ইনজেকশন দিয়ে বিষপ্রয়োগে মেরেছে এমন বর্ণনাও রয়েছে। বিষপ্রয়োগ করে রেললাইনে লাশ ফেলার ঘটনাও রয়েছে।

গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির অন্যতম সদস্য ড. নাবিলা ইদ্রিস বলেছেন, ‘৫ আগস্টের পর সরকার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু এর মানে এই নয় যে, বাহিনীগুলোতে কর্মরত দোষীরা পরিবর্তন হয়েছে। ৫ আগস্টের পর অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আলামত ধ্বংস করা হয়। মনকে মন কাগজ পোড়ানো হয়েছে সব জায়গায়। ডিজিএফআই বলেন, র‌্যাব বলেন, এনএসআই বলেন, সব জায়গায় আলামত পোড়ানো হয়। বিভিন্ন জায়গায় পুরো ভবনের স্ট্রাকচার বদলে ফেলা হয়।’

গুমের শিকার ব্যক্তির স্বজনরা সম্পত্তি নিয়ে বিপাকে পড়ছেন। অনেকে আর্থিক কষ্টে আছেন। এ বিষয়ে গুম কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী বলেন, এমন একটি আইন করা দরকার যে আইনে কিছু অভাররাইটিং ক্লজ থাকবে যেন দেশে প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়েও তাদের আইনগত সুযোগ দেওয়া যায়। গুম হওয়া ব্যক্তির ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়াই তাদের গুম হওয়ার একটা প্রত্যয়ন বা ডিস এপিয়ারেন্স সার্টিফিটেক প্রডিউস করে যাতে পরিবার-পরিজন সম্পত্তি ইনহেরিট করতে পারে, সেজন্য এই কমিশন থেকে আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে অন্ততপক্ষে আর্থিক দুর্দশা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।