
মহাসড়কে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন ঠেকাতে এক্সেল লোড বা ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১৯ সালে । দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের ২৮ টি স্থানে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বসানোর কথা থাকলেও গত ছয় বছরে কোনো সড়কে তা চালু হয়নি । এই অবস্থায় সড়কের ধারণক্ষমতার বেশি ওজনের যানবাহন চলাচল করছে । ফলে দ্রুত নষ্ট হচ্ছে মহাসড়ক । নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে । বাড়তি সময়েও কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে ।
জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ( বুয়েট ) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো . হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন , ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রগুলো চালু করতে না পারার কারণে সড়কগুলো দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । শুধু তা - ই নয় , দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে । সরকার নীতিমালা করেছে , অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে, প্রকল্প হাতে নিয়েছে , কিন্তু বাস্তবায়নে গাফিলতি হচ্ছে । ফলে জনগণের টাকা নষ্ট হচ্ছে এবং মহাসড়কের স্থায়িত্বও কমে যাচ্ছে । এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে আরও বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে ।
সড়ক ও জনপথ ( সওজ ) অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে , অন্তর্বর্তী সরকার প্রকল্পটি কিছুটা কাটছাঁট করে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ২৮ টি থেকে কমিয়ে ২৫ টি করার অনুমতি দিয়েছে । একই সঙ্গে প্রকল্প ব্যয়ও ২১ কোটি টাকা কমানো হয়েছে । আগে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা , যা কমিয়ে ১ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা করা হয়েছে । শুরুতে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য জমি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬৪ হেক্টর । বর্তমানে তা কমিয়ে ৪৩.৮৭ হেক্টর করা হয়েছে । প্রকল্প সূত্র জানায় , ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের কাজ দুটি ধাপে শেষ করার কথা ছিল । প্রথম ধাপে কেন্দ্রগুলো নির্মাণ করা এবং দ্বিতীয় ধাপে এটি পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি বসানো । কিন্তু এখনো অনেক জায়গায় সিভিল ওয়ার্ক ( মূল নির্মাণকাজ ) শেষ হয়নি । এরই মধ্যে আগের সরকারের সময়ে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আনার টেন্ডার ( দরপত্র ) প্রক্রিয়া অন্তর্বর্তী সরকার বাতিল করেছে এবং নতুন করে দরপত্র নথি তৈরি করতে বলেছে । নতুন করে আবার টেন্ডার করতে সময় লাগবে । ফলে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার ওপর তা প্রভাব ফেলবে ।
প্রকল্প সূত্র আরও জানিয়েছে , ২৮ টি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের মধ্যে দিনাজপুরের হিলি , মাদারীপুর ও গাজীপুরের কেন্দ্র বাতিল করা হয়েছে । বাকি ২৫ টি কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে । এগুলোর মধ্যে ১০ টির নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে , ৭ টির কাজ চলমান এবং ৮ টির কাজ জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় স্থানীয় লোকজন করতে দিচ্ছে না । এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৫৫ শতাংশ । সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বলেন , “মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণে অনেক সময় লেগেছে । যেখানে আমরা জমি চেয়েছিলাম, সেখানে না পাওয়ায় সাইজ ( আকার ) পরিবর্তন হয়েছে । ফলে ডিজাইনেও ( নকশা ) পরিবর্তন করতে হয়েছে । এর কারণে কিছুটা দেরি হয়েছে । তবে কিছু অংশে সিভিল ওয়ার্কের কাজ এগিয়েছে । যন্ত্রপাতি বসানোর জন্য টেন্ডার হয়েছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়েছে । এ মাসের শেষে আবারও টেন্ডার করা হবে । '
ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা চ্যালেঞ্জ হবে । যন্ত্রপাতি কেনা ও অপারেশনের কাজের জন্য টেন্ডার বাতিল করে নতুন করে করতে হচ্ছে । এতে আরও সময় লাগবে । এ ছাড়া স্থানীয় লোকজনের বাধা এবং জমি অধিগ্রহণ জটিলতা প্রকল্পের গতি কমিয়ে দিচ্ছে । সরকার ২০১২ সালে অতিরিক্ত পণ্যবাহী যান চলাচল ঠেকাতে এক্সেল লোড নীতিমালা প্রণয়ন করে ।
কিন্তু গত ১৩ বছরেও ওই নীতিমালা অনুযায়ী জরিমানা আদায় করা যায়নি বলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে । এক্সেল লোড নিয়ে সওজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে , ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পথের যানবাহনগুলোর অনুমোদিত পরিমাপের চেয়ে অতিরিক্ত ওজন বহন করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি । অতিরিক্ত ওজন বহনের কারণে সড়ক - মহাসড়ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । সওজকে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামতে প্রতিবছর বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয় । এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় প্রায় ২০ শতাংশ কমানো সম্ভব ।
সওজের তথ্য বলছে , চলতি বছরে ১০ টি সড়ক বিভাগের নতুন করে প্রায় ১ হাজার ৪৭৮ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । অর্থাৎ সড়কে খানাখন্দ বা পিচ ও পাথর উঠে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে । ক্ষতিগ্রস্ত এসব সড়ক সংস্কারে প্রায় ২ হাজার ৯০৭ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয় হবে । বিদ্যমান এক্সেল লোড নীতিমালা অনুযায়ী , মহাসড়কে চলাচল করা ৬ ঢাকাবিশিষ্ট মোটরযানের সর্বোচ্চ ওজন সীমা ( যানবাহন , মালামালসহ ) ২২ টন , ১০ চাকাবিশিষ্ট যানবাহনের সর্বোচ্চ সীমা ৩০ টন এবং ১৪ চাকাবিশিষ্ট মোটরযানের সর্বোচ্চ সীমা ৪০ টন নির্ধারণ করা হয়েছে । নীতিমালা না মানলে ২ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে ।