
৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে শেখ হাসিনা যখন পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তখন বাংলাদেশ জুড়ে বিশৃংখলা বিরাজমান। আগের প্রায় ৩ সপ্তাহ ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নানান অঙ্গসংগঠন এবং পুলিশ মিলে সহস্রাধিক মানুষকে গুলি করে ও কুপিয়ে খুন করেছে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন জুলাইয়ের শেষার্ধ এবং আগস্টের প্রথমার্ধের ৪ সপ্তাহে ১৪০০ এর বেশি মানুষ খুন হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরও ঢাকার যাত্রাবাড়ী, সাভার, উত্তরাসহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের গুলিতে বেশ কিছু মানুষ নিহত হয়েছেন। ছাত্র-জনতাও পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের পাল্টা প্রতিরোধ করেছে এবং কয়েক জায়গায় থানায় আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বেশ কিছু ঘটনায় আওয়ামী লীগ বা পুলিশ সন্দেহে গণপিটুনিতে অনেকে নিহত হয়েছেন ওইদিন।
উত্তরা ছিল পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের একটি হটস্পট। জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত উত্তরাতে প্রতিরোধ জারি রেখেছিলেন ছাত্র-জনতা। এই স্পটে হতাহত হন বহু মানুষ।
৫ আগস্ট সকাল থেকে উত্তরা বিএনএস-এ রাস্তায় ব্লকেড দেয় সেনাবাহিনী। তবে হাসিনার পদত্যাগের খবর চাউর হওয়ার পর সেনাবাহিনী ব্লকেড তুলে নেয়। ঢাকামুখী ঢল নামে জনতার। উত্তরা পূর্ব থানার পুলিশ সদস্যরা থানা আক্রান্ত হতে পারে এই আতংকে থানায় আশ্রয় নিয়ে মুহুর্মুহু গুলি করতে থাকেন। গুঞ্জন রটে, বিভিন্ন ছাদ থেকে পুলিশের সাথে মিলে গুলি করছে ছাত্রলীগের সদস্যরা। ফলে ছাত্র-জনতা মিলে বিভিন্ন ছাদে ‘ছাত্রলীগ’ খোঁজা শুরু করে। এই খোঁজাখুঁজিতে জনতার হাতে পড়ে ভুল সন্দেহে গণপিটুনিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান রবিউল ইসলাম লিমন নামে এক যুবক। ছাত্রলীগ সন্দেহ করা রবিউলকে গণপিটুনি দেওয়ার পর গাছে ঝুলিয়ে রাখে উন্মত্ত জনতা। ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কারো কাছেই সঠিক তথ্য ছিল গণপিটুনিতে মারা যাওয়া লোকটি আসলে কে? যে যার মতো করে প্রচার করেছেন। কেউ তাকে আখ্যা দিয়েছেন ‘আবু সাঈদকে গুলি করা পুলিশ সদস্য’, কেউ বলেছেন, ‘গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের পিএস’, কেউ আখ্যা দেন ‘ছাত্রলীগ নেতা’ হিসেবে। গণমাধ্যমও তখন ছিল বিভ্রান্ত। কোন কোন সংবাদমাধ্যমের খবরেও নিহতকে ‘ছাত্রলীগ নেতা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
তবে দ্য ডিসেন্ট এর অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে যে, লিমন আসলে ছাত্রলীগ বা পুলিশ ছিলেন না। জুলাই-আগস্টের হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয় একজন তরুণ। তার ফেসবুক একাউন্টে এক্টিভিটি, তার পরিবার এবং তার নিহত হওয়ার ঘটনার সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ৫ আগস্ট দুপুরে হাসিনার পতন উদযাপনের ‘বিজয় মিছিলে’ অংশ নিতে রাস্তায় নেমেছিলেন লিমন। এবং ঘটনাস্থলে পুলিশের গুলির শব্দ শুনে গলিতে আশ্রয় নেয়া লিমনকে মেরে ফেলা হয় সম্পূর্ণ ভুল সন্দেহের বশে।
ফেসবুকে আন্দোলনের পক্ষে সরব ছিলেন রবিউল লিমন
রবিউল ইসলাম লিমনের ফেসবুক আইডি ঘেঁটে দেখা যায় জুলাই মাসে মাঝামাঝিতে আন্দোলন শুরুর পর থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের পক্ষে এবং সরকারের আচরণের বিপক্ষে অনলাইনে ব্যাপকভাবে সরব ছিলেন তিনি।
৪ আগস্ট আন্দোলনের পক্ষে ৬টি পোস্ট করেছেন নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে। সেনাবাহিনীকে আন্দোলনের পক্ষে থাকার আহ্বান জানিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি।
রবিউল ইসলাম লিমনের ফেসবুক প্রোফাইলের সর্বশেষ পোস্ট ছিল ৫ আগস্ট বিকালে | ফেসবুক
৫ আগস্টও তিনি ৬ পোস্ট করেন নিজের প্রোফাইল থেকে। ইংরেজিতে লিখেন, “Abrar, Abu Sayed, Mugdho, and the others are smiling from heaven. Heroes never die.”
রবিউলের যে প্রোফাইল ছবিটি রয়েছে সেখানে একজন পুলিশ সদস্য একজন তরুণের মুখ চেপে ধরেছেন এমন ছবির উপর ইংরেজিতে লেখা Stop one voice, ten will rise. অর্থাৎ একজনের মুখ বন্ধ করলে ১০জন জেগে উঠবে। ১ আগস্ট প্রোফাইল ছবিটি আপডেট করেন রবিউল।
সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয় পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর লিমনের পোস্ট।
মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর লিমনেরও একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়।
১৫ জুলাই পলাতক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বক্তব্যের সমালোচনা করেও পোস্ট করেন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বললেন
রবিউল লিমনকে মারার ঘটনা কাছ থেকে দেখেছেন এরকম অন্তত ৩ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলেছে দ্য ডিসেন্ট। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য থেকে প্রমাণ মেলে রবিউলকে ভুল সন্দেহের বশে পিটিয়ে মেরে ফেলে উন্মত্ত জনতা।
ওমর ফারুক নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী লিমনকে হত্যার ঘটনা কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “৫ আগস্ট দুপুর একটা-দেড়টার দিকে শোনা যাইতেছিল যে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবে। আর্মি বিএনএসের ওখানে ব্লকেড দিয়ে রাখসিল। এক পর্যায়ে আর্মি ব্লকেড ছেড়ে দেয়। তখন লোকজন ঢাকার দিকে যাওয়া শুরু করে। আমি তখন বিএনএসের ওখানেই ছিলাম।”
“তো ব্লকেড ছেড়ে দেওয়ার পর আমি এবং আমার সাথের আরেকজন ওখান থেকে হাউজ বিল্ডিংয়ের এদিকে আসি। এদিকে আসার পর গুলির আওয়াজ শুনতেছিলাম। সবাই বলাবলি করতেসিল যে, ছাত্রলীগ গুলি করতেছে। আমরাও একটু ভয় পেয়ে একটা জায়গায় আশ্রয় নিই। গুলি একটু থামার পর বের হই। সবাই তখন এ বাড়ি ও বাড়িতে ছাত্রলীগ খুঁজতেসিল। সবাই মনে করছিল আশপাশের বাড়ির ছাদ থেকে কেউ গুলি করতেসে”, বলেন ওমর ফারুক।
“আমি হাউজ বিল্ডিং পুলিশ বক্সটার কাছে আসার পর দেখলাম একটা লোককে ছাত্রলীগ বলে ৪/৫ জন মারতেছে আর উনি হাঁটতেছেন। মাথা থেকে রক্ত পড়তেছিল। তাকে বলতে শুনেছিলাম, আমি ছাত্রলীগ না। আমি গার্মেন্টসে চাকরি করি। প্লিজ আমাকে মাইরেন না ভাই। আমি কী দোষ করছি। আমাকে কেন মারতেছেন?”
ফারুক বলেন, “একটা পর্যায়ে উনি দৌড় দিয়ে উত্তরা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস যে বাড়িটাতে যেটাকে মৌসুমির বাড়ি বলা হয় সে বাড়িতে ঢুকছেন। তো তখন ২/৩ জন বলতেছিল উনি ছাত্রলীগ না, উনারে মাইরেন না। ওই ২/৩ জন লোকও উনার পিছে পিছে ওই বাড়িতে ঢুকছে। ওখানে ৫/৭ মিনিট মনে হয় ছিল।”
“হঠাৎ করে আবার দেখি ওই লোকটারে আবার মারতে মারতে আনতেছে। উনারেই যে মারতেছে এটা প্রথমে বুঝিনাই। পরে বুঝলাম ওনারেই। ১৫/২০ জন ইচ্ছামত মারতেছে। যে যেমনে পারছে মারছে। আমাদের এলাকার একজন গিয়ে উনারে জড়ায়া ধরছে যেন না মারে। ও বাঁচানোর চেষ্টা করছে। লাস্টে ওরেও মারা শুরু করছে ‘ছাত্রলীগের দালাল’ বলে। পরে সে ছেড়ে দিছে। পরে ওই লোকটাকে টেনে হাউজ বিল্ডিং কর্পোরেশন স্কুলের সামনে গাছে ঝুলায়া মারা শুরু করছে। তখনই সম্ভবত সে মারা গেছে। দেড়টা থেকে আড়াইটা- এই এক ঘন্টার মধ্যে তাকে হত্যা করা হয়”, বলছিলেন ওমর ফারুক।
তিনি আরও বলেন, “পরে আমরা জানতে পারলাম যে গুলির আওয়াজ শোনা যাইতেছিল সেগুলা আসলে আসতেছিল উত্তরা পূর্ব থানা থেকে। হাসিনা পালানোর খবরে পুলিশ আতংকিত হয়ে থানার ভেতর থেকে গুলি করতেছিল। লোকজন সেদিকে থানা পোড়াইতে গেছিল। ওই সময় ছাত্রলীগ আসবে কোত্থেকে!”
মোহাম্মদ রিয়াদ নামে আরও একজন প্রত্যক্ষদর্শী লিমনকে ভিড়ের মধ্যে মারতে দেখেছেন। তার সাথে কথা বললে তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “ওইদিন হাসিনা পালানোর পর মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শোনা যাইতেছিল। সবাই বলতেছিল ছাত্রলীগ গুলি করতেছে। বিভিন্ন বাড়িতে ছাত্রলীগ খোঁজা শুরু করে লোকজন। আসলে গুলির শব্দ আসতেছিল উত্তরা পূর্ব থানা থেকে। ওই লোকটা হাউজ বিল্ডিংয়ে উত্তরা ইউনিভার্সিটি আর পাশে একটা বড় বিল্ডিং হইতেছে, এই দুই বিল্ডিংয়ের চিপা গলিতে নাকি লুকায়া ছিলেন। তখন গুলির শব্দ শুনে সবাই একটু সাইড হয়ে গেছিল। কেউ ওদিকে রাস্তায় গেছে, কেউ ডানে-বামে ঢুকছে।”
“তো উনারে আন্ডারকন্সট্রাকশন বিল্ডিংয়ের ওই চিপা থেকে টাইনা আইনা পোলাপান বলতেছিল, ‘তুই গুলি করছোস, তুই ছাত্রলীগ।’ এরপর ইচ্ছামত গণপিটুনি দিয়ে ওরে মাইরা ফালাইছে। এরপর সমানে বাইড়াইতেছিল ওর মাথায়। ওরে ধরার পর ১০ মিনিটের মধ্যে মাইরা ফালাইছে”, বলেন রিয়াদ।
“লোকটাকে মারতে মারতে একপর্যায়ে যখন গাছে উল্টা করে ঝুঁলিয়ে মারা শুরু করে তখন আমি কাছে গিয়ে বলছি ভাই আর মাইরেন না। লোকটা তো মারা গেছে। লাশের সাথে এমন করা ঠিক না। লোকটার মাথা থেকে রক্ত-মগজ বেরিয়ে আসতেছিল। আমি এ কথা বলার পর কয়েকজন আমার দিকে তেড়ে আসছে। ওরা আমারে বলে ‘এই মিয়া আপনি কি ওগো পক্ষের লোক নাকি!’ আমি একটু ভয় পেয়ে চুপ করে যাই। যদি আমাকেও মারা শুরু করে!”
রিয়াদ বলতে থাকেন, “পরে আমি পাশে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করি উনাকে যে ছাত্রলীগ বলে মারা হইছে উনার কাছে কি কিছু পাইছে অস্ত্রটস্ত্র? ওরা বলে পায়নাই। পকেটে একটা আইডেন্টিটি কার্ড পাইছে গার্মেন্টসের মার্চেন্ডাইজার। আমার এতটুকু মনে আছে ওরা বলছে কোন অস্ত্র পায়নাই। আমি আর কথা বাড়াই নাই। এরপর আমি আরেকজন লোককে জিজ্ঞেস করি, উনাকে যে আপনারা মারছেন উনার কাছে কোন প্রুফ পাইছেন? তার কাছে কোন অস্ত্র দেখছেন? বলে, না অস্ত্রটস্ত্র দেখি নাই। ওরা বলে, সে বিল্ডিংয়ের চিপায় লুকাইলো কেন? সে ওখান থেকে গুলি করতেছিল এজন্য লুকাইছে। যারা মারছে এদের দেখে মনে হইলো এরা সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা না। আমার মনে হয় লোকটা গুলি সাউন্ড গ্রেনেড এগুলার শব্দ শুনে ওই চিপায় গিয়ে লুকাইছিলো”, বলে থামেন রিয়াদ।
গণমাধ্যমে ভুল খবর
গুগলে সার্চ করে ৫ আগস্ট ’’গুলি করার অভিযোগে হত্যার পর গাছে ঝোলানো হলো যুবকের লাশ’’ শিরোনামে আজকের পত্রিকার একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয় ওইদিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে উত্তরার ৮ নম্বর সেক্টরের স্টাফ কোয়ার্টারের সামনের একটি গাছে অজ্ঞাত এক যুবকের ঝোলানো মরদেহ দেখা যায়। সেখানে অবস্থানকারী আন্দোলনকারীদের ভাষ্যে আজকের পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, “সেখানে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, যুবকটি ছাত্রলীগ করে। সে হাউজবিল্ডিং এলাকায় পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করেছে। তাঁর ছোড়া গুলিতে এক শিশু আহত হয়েছে।”
“গুলি শেষ হয়ে যাওয়ার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রসহ অন্যান্য লোকজন তাকে ধরে গণধোলাই দেয়। তারপর সে মারা গেলে পায়ে রশি বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়।”
এখানে স্পষ্টতই পত্রিকাটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পেয়ে তথ্য উপস্থাপন করেনি। ঘটনাস্থলে থাকা আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে যা জানা গেছে তাই উপস্থাপন করেছে। এছাড়া নিহত ব্যক্তির পরিচয়ও তখন অজানা ছিল।
এছাড়া ওইদিন যায়যায়দিন পত্রিকায় “উত্তরায় মেরে গাছে ঝুলিয়ে দিলো এক ছাত্রলীগ নেতাকে” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “উত্তরার হাউজ বিল্ডিঙে উৎসব রত ছাত্র-জনতার উপর ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা হঠাৎ করে গুলি শুরু করে। এক পর্যায়ে উত্তেজিত জানত অস্র সহ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীকে ধরে পেলে। এই সময় উত্তেজিত জনতার পিটুনিতে সন্ত্রাসী নিহত হয়। পরে নিহত ব্যক্তিকে পা উপরে দিকে রেখে একটি গাছে জুলিয়ে রাখতে দেখা যায়।”
যায়যায়দিন প্রতিবেদনে নিহত ব্যক্তির নাম পরিচয় উল্লেখ করেনি। পরিচয় উল্লেখ ছাড়াই সূত্রহীনভাবে নিহত ব্যাক্তিকে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে প্রচার করেছে পত্রিকাটি।
ওই সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বরাত দিয়ে গত ১৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলোর “জমির বিরোধে খুন, দুর্ঘটনায় মৃত্যু, তবু তাঁরা জুলাই শহীদ” শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “রবিউলের বিষয়ে গণমাধ্যমের খবরে তখন বলা হয়েছিল, তিনি হাউস বিল্ডিং এলাকায় পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করছিলেন। তাঁর ছোড়া গুলিতে এক শিশু আহত হয়। গুলি শেষ হয়ে গেলে তিনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন তাঁকে ধরে মারধর করা হয়। তাঁর লাশ গাছে বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।”
পরবর্তীতে রবিউল লিমনের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথম আলো খবরটির প্রতিবাদ জানানো হলে পরবর্তী একটি ফলোআপ প্রতিবেদনে পরিবারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রথম আলো লিখেছে, “রবিউল সম্পর্কে প্রথম আলোর নিজস্ব কোন বক্তব্য নেই। পুলিশের নথি ও ঘটনার সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।”
রবিউল ছাত্রলীগ করতেন না
রবিউল লিমন সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে ২০১৭ সালে গ্রাজুয়েট হন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্র রাজনীতি করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া রবিউলকে যখন মারা হয় তখন তিনি একজন কর্মজীবি ছিলেন। তিনি ৬ বছর ধরে পার্ল গ্লোবাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
কথা হয় রবিউলের সহপাঠী সাইফুর রহমানে বাঁধনের সাথে। তিনি বলেন, “রবিউল কোন রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলো না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তো রাজনীতি করার কোন সুযোগই ছিল না। ও খুবই অমায়িক, ভদ্র একটা মানুষ ছিল। সিগারেট পর্যন্ত কোন দিন খায়নাই। ও তখন থেকেই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন করতো। বইপড়া, রক্তদান, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা, অসুস্থ মানুষদের জন্য ফান্ড রেইজ করা, রাস্তায় পড়ে থাকা অসহায় মানুষদের বৃদ্ধাশ্রমে রাখার ব্যবস্থা করা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।”
৩০ জুলাই রাষ্ট্রীয় শোক দিবস প্রতাখ্যান করে আন্দোলনকারীদের সাথে মিলে নিজের প্রোফাইল লাল করেন লিমন
রবিউল ইন্টার্নশিপ করেন ডিভাইন গ্রুপ নামের একটি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানে। কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির ফ্যাব্রিক প্রোডাকশন ম্যানেজার তুষারের সাথে। তার অধীনেই ইন্টার্ন ছিলেন রবিউল।
তুষার বলেন, রবিউল কতটা অমায়িক আর ভদ্র ছেলে ছিল তা বলে বুঝানো যাবেনা। আমি যেমন তাকে প্রফেশনালি চিনি তেমনি পারিবারিকভাবেও তাকে চিনি। তার বাবা আর আমার বাবা কলিগ ছিল। রবিউল কখনোই কোন রাজনীতি করেনি।
পার্ল গ্লোবালে রবিউলের সাথে একই টিমে কাজ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার গোলাম রাব্বানী সোহাগ। রাব্বানী দ্য ডিসেন্ট-কে বলেন, ”রবিউল আমাদের প্রতিষ্ঠানে ৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছে। তার মত অতুলনীয় ভদ্র, অমায়িক মানুষ কম দেখেছি। সে কখনো আওয়ামীলীগ করেনি। অথচ তাকে সে অপবাদ দিয়েই মারা হলো।”
পার্ল গ্লোবাল-এ কর্মরত লিমনের ভিজিটিং কার্ড | পরিবার থেকে প্রাপ্ত ছবি
রবিউল ইসলাম প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশনের একজন স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। কথা হয় সংগঠনটির একজন স্বেচ্ছাসেব আমিনুর রহমান আশিকের সাথে যিনি এই সংগঠনের রবিউলের সাথে একসাথে কাজ করেছেন।
আশিক বলেন, “আমি আর রবিউল ভাই বেগুনবাড়ি বস্তিতে দীর্ঘদিন বাচ্চাদের পড়িয়েছি। আমরা কাজটা সম্পূর্ণ ফ্রিতে করেছি। রবিউল ভাই খুবই ভালো একজন মানুষ ছিলেন। উনার মুখে আমি কখনোই একটা নেগেটিভ কথাও শুনিনাই। উনি আওয়ামীলীগকে সাপোর্ট করেন এমন কোন কথা কোনদিন শুনিনাই। উনার সাথে যা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অন্যায় হয়েছে। এটা মেনে নেওয়ার মত না।” বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ফেলেন আশিক।
প্রচেষ্টা-র ঈদ উপহার বিতরণ করছেন লিমন | পরিবার থেকে প্রাপ্ত
রবিউলের প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস ছিল। ফেসবুকে বই লাভারজ পোলাপান গ্রুপের এখনো এডমিন হিসেবে আছে রবিউলের আইডিটি।
রবিউল লিমন মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী সাবরিনা আক্তার তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, যার বয়স বর্তমানে আট মাস। লিমনের স্ত্রীর দাবি, তার স্বামী ছাত্রলীগ দূরে থাক, কোন রাজনৈতিক দলের সাথেই সম্পৃক্ত ছিলেন না।
সাবরিনা বলেন, “আমার স্বামীকে নির্যাতন করে মারা হয়েছে এটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। কিন্তু আরও কষ্টের বিষয় হচ্ছে তার ব্যাপারে অনেকগুলো অপবাদ ছড়ানো হয়েছে। অনলাইনে তাকে আবু সাঈদের হত্যাকারী পুলিশ সদস্য বলা হয়েছে, গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের পিএস হিসেবে প্রচার করা হয়েছে, কেউ বলেছে ছাত্রলীগ। আমাদের এখন সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। যারা লিমনকে চিনে তারা সত্যটা জানে। কিন্তু যারা চিনেনা তারা তো আমাদের হীন চোখে দেখতেছে যে ভুয়া শহীদ হইসে, টাকার জন্য নাম উঠাইসে। এটা তো আমাদের জন্য অপমানজনক। আমরা তো টাকার জন্য নাম উঠাইনাই। সরকার টাকা দিবে এটাও তো আমরা জানতাম না। আমরা শুধুমাত্র তার ব্যাপারে ছড়ানো অপবাদগুলো দূর করতে চাইছি।” বলেন সাবরিনা।