Image description

চৌদ্দ মাস পার করলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আসছে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই সাময়িক সরকারের উপদেষ্টা ও তাদের নিয়োগ করা সাময়িক কর্মকর্তাদের বিদায়ের ঘণ্টা বাজবে। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক  সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরাপদ প্রস্থানের একমাত্র স্বাভাবিক পথ। কিন্তু নির্বাচনের কয়েক মাস আগে হঠাৎ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আলোচনার সূত্রপাত করেছেন উপদেষ্টাদের নিয়োগদাতাদের একজন যিনি নিজেও উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের গড়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেন, অনেক উপদেষ্টা নিজেদের আখের গুছিয়েছেন অথবা গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ রেখেছেন এবং তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথাও ভাবছেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম কোনো উপদেষ্টার নাম বলেননি। তবে তিনি এটাও উল্লেখ করেন, সময় আসলে তাদের নাম উন্মুক্ত করা হবে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্য ঘিরে নানামুখী প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। হচ্ছে নানা আলোচনা। উপদেষ্টাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের হতাশার বিষয়টি যেমন তার এই বক্তব্যে সামনে এসেছে তেমনি বর্তমান উপদেষ্টাদের যে ছাত্র নেতৃত্বই বেছে নিয়েছিল তাও অনেকে স্মরণে এনেছেন।

নাহিদের বিস্ফোরক মন্তব্যের রেশ কাটতে না কাটতেই আরও কঠোর ভাষায় উপদেষ্টাদের সতর্ক করেছেন অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া আরেক তরুণ মুখ সারজিস আলম। তিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক। মঙ্গলবার নওগাঁ জেলা এনসিপি’র সমন্বয় সভায় তিনি বলেন, কিছু উপদেষ্টা কোনোভাবে দায়সারা দায়িত্ব পালন করছেন। যেন তারা নির্বাচনের মধ্যদিয়ে এক্সিট নিতে পারলেই হলো। এই দায়সারা দায়িত্ব নেয়ার জন্য অভ্যুত্থান পরবর্তী একটি সরকার কাজ করতে পারে না। এত শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এখানে আছেন, এমনটা করলে দেশের মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না। যারা এ ধরনের চিন্তা করেন, তাদের জন্য বলতে হয়, মৃত্যু ছাড়া কোনো সেফ এক্সিট নেই। পৃথিবীর যে প্রান্তে যান, বাংলাদেশের মানুষ তাদের ধরবে। 

উপদেষ্টাদের নিয়ে এনসিপি’র এই দুই নেতার এমন বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। উপদেষ্টাদের নিয়ে সরকারের বছর পূর্তির আগে থেকেই নানা আলোচনা ছিল। কোনো কোনো উপদেষ্টার পারফরমেন্স নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেকে। কোনো কোনো উপদেষ্টা আলোচিত হয়েছেন নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য। উপদেষ্টার পিএস, এপিএসের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগও এসেছে। ’২৪-এর গণহত্যায় দায়ী আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতাদের রক্ষায় কোনো কোনো উপদেষ্টা কাজ করেছে- প্রচ্ছন্ন এমন ইঙ্গিতও করা হয় অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে। সরকারের বছরপূর্তির পর অনেকে হিসাব মেলাচ্ছেন তাদের কার্যক্রমের। অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তা কোনোভাবেই মিলছে না। প্রশাসনের স্থবিরতা কাটেনি। ঘুষ, দুর্নীতির অভিযোগ এখনো আসছে পুরনো ধারায়। এমন অবস্থায় অনেকে বলছেন একটি নির্বাচিত সরকার আসলেই কেবল বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও জোর দিয়ে বার বার বলছেন, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পর্যন্তই তার দায়িত্ব। এরপর তার আর এক মুহূর্ত থাকার কোনো ইচ্ছা নেই। 
অন্যদিকে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক দল এনসিপি এখনো নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত নিবন্ধন ও প্রতীক পায়নি। নেতাদের কেউ কেউ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন। আসছে নির্বাচনে দলটির ভূমিকা এবং অবস্থান কী হবে এটি পরিষ্কার নয়। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া অন্য শক্তিগুলো বিভক্ত। এমন পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হবে কিনা এটি নিয়েও আছে দ্বিধা-সংশয়। এমন অবস্থায় উপদেষ্টাদের নিয়ে খোদ নিয়োগদাতাদের একের পর এক মন্তব্য নানা প্রশ্ন তৈরি করছে। সাধারণ মানুষের মাঝেও দেখা দিয়েছে কৌতূহল। 

সেফ এক্সিট নিয়ে এনসিপি নেতাদের বক্তব্যের বিষয়ে গতকাল একজন উপদেষ্টা অবশ্য কথা বলেছেন। নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের বিষয়ে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, নাহিদ ইসলাম কেন, কোন কথা বললেন, উনি যে নামগুলো প্রকাশ করেননি, যে আলোচনার বিষয়গুলো প্রকাশ করেননি, সেটা নিয়ে আমি কথা বলবো কেন? তিনি বলেন, আমি যেটুকু দেখতে পাই খোলা চোখে সেটা হলো- সকল রাজনৈতিক দলের মতো এই নবগঠিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের ভালো একটা ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ আছে।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, এটা উনি অভিমান থেকে বলেছেন, নাকি আসলে কোনো একটা ব্যাপারে ওনার গ্রিভেন্স আছে। এই বিষয়গুলো পরিষ্কার ওনাকে করতে হবে। উনি যদি কখনো কোনো বিষয় পরিষ্কার করেন, তখন সেটা নিয়ে সরকারের বক্তব্যের কথা আসে। তার আগে সরকারের বক্তব্যের কোনো সুযোগ নেই।
উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট নিয়ে এনসিপি নেতাদের মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নানা আলোচনা হচ্ছে। এই মন্তব্যের মাধ্যমে সরকার এবং সরকার সমর্থিত শক্তিগুলোর দুর্বলতাই প্রকাশ পাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। 

এ বিষয়ে এক আলোচনায় বিএনপি’র সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা বলেছেন, আমার মনে হয়, সেফ এক্সিট খুঁজতে উপদেষ্টাদের খুব কষ্ট করতে হবে না, কারণ ম্যাক্সিমাম উপদেষ্টা ডুয়েল সিটিজেনশিপ নিয়ে চলছেন। সুতরাং তাদের একটা বড় অংশই দেশের বাইরে অটোমেটিক্যালি চলে যেতে পারবেন। এক টকশো আলোচনায় তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার কারণে আওয়ামী লীগ কোনো প্রকার অনুশোচনা না করেই রাজনীতিতে ফেরার চিন্তা করছে। 

২৪-এর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া আরেক দল গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানও এনসিপি নেতাদের বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন। এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ‘আমি মনে করি না বয়স্ক উপদেষ্টারা দুর্নীতি করেছেন। এমন তথ্যও শোনা যায় না। মূলত তাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক জ্ঞান না থাকার কারণে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের পার্ট হয়েও তারা কিছু করতে পারেননি। তাদের গণ-অভ্যুত্থানেও কোনো ভূমিকা নাই, হাসিনার বিরুদ্ধেও কখনো রাজপথে নামেননি। বৃদ্ধ বয়সে নাতিপুতির সঙ্গে খেলাধুলা করে সময় কাটানো মানুষগুলোকে প্রলোভন দেখিয়ে সরকারের উপদেষ্টা বানিয়ে ভুল করেছে কতিপয় ছাত্র নেতৃত্ব। অর্থাৎ গণ-অভ্যুত্থানের পরে অদক্ষ লোককে সরকারের উপদেষ্টা বানানোর পুরোপুরি দায় কতিপয় ছাত্র নেতৃত্বের। তাদের ভুল সিলেকশনে এতবড় গণ-অভ্যুত্থানের পরেও রাষ্ট্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেটা ছাত্র নেতৃত্বরা ইদানীং স্বীকার করছে যে, তাদের উপর বিশ্বাস করে ভুল করেছে। এই ভুলের খেসারত পুরো জাতিকে দিতে হচ্ছে। রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তনের জন্য ভবিষ্যতে আরেকটা গণ-অভ্যুত্থান হলেও হতে পারে। সেই গণ-অভ্যুত্থানের পরে সবচেয়ে বেশি খেসারত দেওয়া লাগতে পারে তাদের, যাদের ভুলের কারণে ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে, আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিমদের রক্ত বৃথা গেছে! সে সময় বয়স্ক উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিটের প্রয়োজন পড়বে না। প্রাকৃতিক নিয়মেই তখন তারা আর পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন না। তখন সেফ এক্সিট খুঁজতে হবে এখনকার কতিপয় নেতৃত্বকে, যারা প্রতিনিয়ত ভুল করছে। ওই স্ট্যাটাসে রাশেদ অবশ্য আশার কথাও বলেন।
তিনি লিখেন, তবে কারোরই সেফ এক্সিট লাগবে না, যদি আগামী ৫ মাস কোনো ভুল না করে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সঠিক সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা গণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হতে পারি।