
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে প্রকাশ্যে রাস্তায় প্রাইভেটকারে গুলি করে খুন করা হয় রাউজানের আব্দুল হাকিমকে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে এলাকায় নিহত আব্দুল হাকিমের সুনাম থাকলেও রাজনীতির বলি হয়েছেন বলে ধারণা স্বজনদের। নিহত আব্দুল হাকিম বিএনপি’র নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী বলে পরিচিত। গিয়াস কাদেরের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য গোলাম আকবর খোন্দকারের বিরোধ চলছে। যদিও স্থানীয় বিএনপি নেতাদের একটি অংশের দাবি, রাউজানকে অস্থির করতে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগই এমন ঘটনার পেছনে দায়ী। এদিকে আবদুল হাকিম বিএনপির কর্মী নন বলে দাবি করেছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
ওদিকে স্থানীয় বিএনপি’র ওই অংশটি বলছে, বিদেশে পলাতক পুলিশের তালিকাভুক্ত রাউজানের শীর্ষ সন্ত্রাসী ফজল হকের ক্যাডারদের হাতে আবদুল হাকিম খুন হয়েছেন। এর আগেও ফজল হক বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তি। তাকে জুমার নামাজে যাওয়ার পথে হত্যা করা হয়। একই কায়দায় আব্দুল হাকিমকে খুন করে দুর্বৃত্তরা।
এরআগে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের মদুনাঘাট বাজারের পানি শোধনাগার মূল ফটকের সামনে পৌঁছালে অস্ত্রধারীরা গাড়ি লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবদুল হাকিম মারা যান। গুলিবিদ্ধ হন গাড়িচালকও। ঘটনার মুহূর্তের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভিডিওতে দু’জনকে দেখা গেলেও গাড়ির আশপাশে আরও কয়েকজন অস্ত্রধারী ছিল।
সরজমিন দেখা যায়, হাটহাজারীর মদুনাঘাট বাজারের পানি শোধনাগার কেন্দ্রের মূল ফটকের সামনে থেকে আনুমানিক ২০০ মিটার দূরে একটি পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ৯ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দেখা যায়, সাদা রঙের প্রাইভেটকারটি পানি শোধনাগারের সামনে দাঁড়ানো ছিল। ভিডিওতে অন্তত পাঁচটি গুলির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। গুলি করা ব্যক্তির পাশে হেলমেট পরা আরেকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
মদুনাঘাট পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, সন্ত্রাসীরা চারটি মোটরসাইকেলে আসে। চার-পাঁচ মিনিটের কম সময়ের মধ্যেই ঘটনাটি ঘটে। কয়েক মিনিটে সন্ত্রাসীরা ১০-১২টি গুলি ছোড়ে। এরপর দ্রুত পালিয়ে যায়। ১০ মিনিট পরই ঘটনাস্থলে পৌঁছান পুলিশ সদস্যরা।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কারে চড়ে আব্দুল হাকিম চট্টগ্রাম নগরীর দিকে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার সংযোগস্থল মদুনাঘাট সেতু পার হওয়ার পর তিনটি মোটর সাইকেলে করে হেলমেট পরা তিনজন এসে গাড়ির সামনে বসা তাকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি করে। এতে গাড়ির সামনের কাচ ফুটো হয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় গাড়ির ভেতর লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে দ্রুত নগরীর অনন্যা আবাসিক এলাকায় বেসরকারি এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, আব্দুল হাকিম রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের পাঁচখাইন গ্রামের বাসিন্দা। তিনি একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। এরপর তিনি রাউজানের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি পান। আওয়ামী লীগের পতনের পর গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, যিনি ফজলে করিমের চাচাতো ভাই, এলাকায় ফিরলে হাকিম তার সঙ্গে যোগ দেন। তবে দলীয় কোনো পদ ছিল না তার।
ভেষজপণ্যের ব্যবসার পাশাপাশি হাকিমের ছিল গরুর খামার। এ ছাড়া গত এক বছর ধরে কর্ণফুলী নদী থেকে বালু উত্তোলনের ব্যবসা করে আসছিলেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, নিহত আব্দুল হাকিমকে আগে কোন অন্যায়ের সাথে জড়িত থাকতে দেখা যায়নি । তিনি এলাকায় ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন এলাকাবাসী।
এদিকে গুলিতে নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতালে ছুটে আসেন স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীরা। স্বজনদের কান্নায় শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে। বিএনপি নেতাদের দাবি, একটি গ্রুপের উস্কানিতে বিএনপির নামে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ রাউজানকে অস্থির করতে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে।
ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব কিংবা দলীয় কোন্দলের জেরে এই হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা স্বজনদের। তবে, কে বা কারা এই হত্যার পেছনে রয়েছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারেনি তারা।
নিহতের বড় ভাই মুহাম্মদ পারভেজ বলেন, ‘কেন আমার ভাইকে হত্যা করলো তা তো জানি না আমরা। কার কথা বলবো আমি? বিএনপির ভেতরে তো অনেক গ্রুপিং। এগুলো তো বলতে পারবো না আমি কিছু।’
এদিকে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করা এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বুধবার বিএনপির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এডভোকেট রুহুল কবির রিজভী জানান, ‘কয়েকটি গণমাধ্যমে নিহত ব্যক্তিকে (আব্দুল হাকিম) বিএনপিকর্মী বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন। নিহত ব্যক্তি ও দুষ্কৃতিকারীদের কেউই বিএনপির নেতাকর্মী নন। এ সহিংস ঘটনা সম্পূর্ণরূপে সমাজবিরোধী কিছু দূর্বৃত্তচক্রের পরিকল্পিত হিংস্র কর্মকাণ্ড। এর সাথে রাজনীতি বা বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।’
এদিকে আব্দুল হাকিম খুনের ঘটনায় বুধবার বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত মামলা দায়ের হয়নি। এ ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে চারজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তবে তাদের পরিচয় জানায়নি পুলিশ। মঙ্গলবার রাতে রাউজানের বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) কাজী মো. তারেক আজিজ জানান, আটক চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। হামিম এগ্রোর মালিক আবদুল হাকিম খুনের ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সম্ভাব্য সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আবদুল হাকিম খুনের ঘটনার তদন্ত চলছে বলে জানিয়ে জেলা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘নিহত আবদুল হাকিমের সঙ্গে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব মাথায় রেখে ঘটনার তদন্ত চলছে। সম্ভাব্য কোনো কিছুকে আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না।’
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি’র দুই কেন্দ্রীয় নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘাতে রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা। গত এক বছরে বিএনপির সাতজন নেতাকর্মীসহ অন্তত এক ডজন খুনের ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ গত ২৯শে জুলাই রাউজানে গিয়ে প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি’র তৎকালীন আহ্বায়ক ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার। এ ঘটনার পর গিয়াস কাদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির পদ হারান। গোলাম আকবরের নেতৃৃত্বাধীন উত্তর জেলার আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।