
বিএনপি কর্মী ও ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন মিলন। ঢাকা ও ফেনীর ৪ মামলার আসামি। আশ্চর্যের বিষয় হলো- সবক’টি মামলায়ই সময় দেখানো হয়েছে এক ঘণ্টা, কোনোটায় আবার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধান। প্রশ্ন উঠেছে একজন মানুষ ঢাকায় থাকলে একঘণ্টার মধ্যে ফেনীতে কি করে থাকেন? বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার দুইটি মামলার মধ্যে একটির ঘটনার
সময় ও তারিখ দেখানো হয়েছে ৪ঠা আগস্ট ২০২৪ বিকাল ৩টা। অন্য ঘটনার সময় ও তারিখ দেখানো হয়েছে সন্ধ্যা। আর ফেনীর একটি মামলায় তারিখ ও সময় দেখানো হয়েছে ৪ঠা আগস্ট দুপুর ১২টা শহরের বড় মসজিদ এলাকা। অন্যটির ঘটনার সময় ও তারিখ দেখানো হয়েছে শহরতলীর মহিপাল এলাকায় বেলা ২টায়। এসব মামলায় আনোয়ার হোসেন মিলন ১৩ই ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন। মিলনের স্ত্রী আমেনা খাতুন এই প্রতিবেদককে বলেন, ব্যবসায়ীক বিরোধের কারণে আমার স্বামীকে ঢাকা ও ফেনীর ৪ মামলায় জড়িয়েছেন ফেনী জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন। অথচ সব মামলা একইদিনে ও কিছু সময়ের ব্যবধানে ঘটনা দেখানো হয়েছে। এ ব্যাপারে জসিম বলেন, আমি কিছুই জানি না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে বিরোধীরা এমন মিথ্যাচার করছে।
সোনাগাজীর বাসিন্দা ঢাকার ব্যবসায়ী ফখরুল ইসলাম ও তার ভাই মিজানুর রহমানকেও চারটি মামলায় আসামি করা হয়। এ মামলার পেছনেও রয়েছে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ। ফখরুল ইসলামের অভিযোগ একই বাড়ির আশরাফ উদ্দিন এবং তার ভাই নাসির উদ্দিন পুলিশের মাধ্যমে তাদের দুই ভাইকে মামলায় জড়িয়েছেন। চাচাতো ভাইদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ ও ব্যবসায়ীক দ্বন্দ্বের জেরে তাকে সে ও তার ভাইকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়।
দেড় মাস জেল খেটে বের হওয়া দাগনভূঞার শাহাদাৎ হোসেন নামে আরেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের দুই নেতার সঙ্গে তার চক্ষু হাসপাতালের ব্যবসা নিয়ে বিরোধের কারণে একাধিক মামলায় আসামি হয়েছেন তিনি। পরে মামলার বাদীকে মোটা অঙ্কের টাকার মাধ্যমে আদালতে এফিডেভিট দিয়ে দেড় মাস পর কারামুক্ত হন। আরেক মামলার বাদী দাগনভূঞা উপজেলার সমাসপুর গ্রামের জামসেদ জানান, তিনি মামলার আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন, কিন্তু বেশির ভাগ আসামি পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা করেছেন। সমপ্রতি এক ফেসবুক লাইভে এসেও তিনি এই তথ্য প্রকাশ করেন।
আরেক হত্যাচেষ্টা মামলার বাদী জেলা যুবদলের সাবেক সদস্য দাগনভূঞার নাছির উদ্দিনও তার কয়েকজন আসামির জামিনের পক্ষ নিয়ে আদালতে এফিডেভিট দিয়েছেন। এ বিষয়ে তার বক্তব্য তড়িঘড়ি করতে গিয়ে ভুল মানুষের নাম ও ঠিকানা লেখার কারণে এ সমস্যা। সর্বত্র আলোচনা- অর্থ বিনিময়ের মাধ্যমে এ কাজ করা হয়েছে। যদি এ অভিযোগ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়ে নাছিরউদ্দিন বলেন, এ ধরনের প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে দিয়ে জুলাই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনা পুঁজি করে সারা দেশের মতো ফেনীতেও চলছে মামলা বাণিজ্য। এসব মামলায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলায় জড়িতদের যেমনি জড়ানো হচ্ছে, তেমনি পারিবারিক, ব্যক্তি ও সামাজিক বিরোধের প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। আসামি করা হয়েছে হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষের লোকদেরও। টার্গেট করে এসব মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে বিত্তশালী, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীদের। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানিতে ফেলা হয়েছে। এতে তছনছ হয়ে যাচ্ছে অনেক সাজানো সংসার। বাড়ছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিরোধ। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শূন্য আলোচিত ফেনী জেলাতে চলছে প্রভাব খাটানোর প্রতিযোগিতা। বড় হাতিয়ার হিসেবে জুলাই অভ্যুত্থানের মামলাকে সামনে আনা হচ্ছে। আর সে প্রতিযোগিতায় নাম এসেছে বহুদলীয় চক্রের। সমপ্রতি জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার আদালত এলাকায় প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে অভিযোগ করেন জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় বেশির ভাগ হত্যাচেষ্টার মামলায় নিরপরাধীদের আসামি করা হচ্ছে। একইভাবে অনেক মামলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাও ফেঁসে যাচ্ছেন। এনিয়ে ক্ষোভ জানান তিনি। ছাগলনাইয়ায় সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াতের পক্ষ থেকেও একই অভিযোগ করা হয়। এ ছাড়া মিথ্যা মামলার অভিযোগ তুলে নিতে অনেক ব্যক্তি গণমাধ্যম ও পুলিশ প্রশাসনের দ্বারস্থ হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
২০২৪ সালের ৪ঠা আগস্ট ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি করে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এতে নিহত হন ৭ আন্দোলনকারী, আহত হয় দেড় শতাধিক। পরদিন ৫ই আগস্ট ফেনী শহরে ফের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এক আন্দোলনকারী। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এ হামলায় সরাসরি নেতৃত্ব দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। দু’দিনের ঘটনায় ফেনী সদর মডেল থানা ও আদালতে ৮টি হত্যাসহ মামলা হয়েছে ৩১টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১১ হাজারের মতো। এরমধ্যে মাহবুবুল হক মাসুম হত্যা মামলায় আদালতে এরইমধ্যে ১৬২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৯টি মামলায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন অনেক আসামি। প্রশ্ন উঠেছে- এসব মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। জেলায় আলোচনা আছে এসব মামলা দায়েরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পলাতক নিজাম হাজারীসহ কয়েকজন নেতা বাদীপক্ষের মদত ও অর্থ বিনিয়োগ করছেন। আবার বাদী নানাভাবে ম্যানেজ হয়ে অর্থ নিয়ে আদালতের মাধ্যমে আবার আসামিদের জামিনের সুযোগ করে দিচ্ছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক এম শাহজাহান সাজু বলেন, যে সব মামলায় তাকে জড়ানো হয়েছে সে সব ঘটনার সময় অর্থাৎ ৪ঠা আগস্ট দুপুর থেকে আমি আদালতেই ছিলাম। ওই সময় অন্য ৭ আইনজীবীর সঙ্গে জেলা ও দায়রা জজের খাস কামরায় একটি জরুরি বৈঠকে হাজির ছিলাম। তারপরও চার মামলায় একমাস কারাভোগ করতে হয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক ও পেশাগত প্রতিহিংসার বলি আমি। তিনি বলেন, মামলা বাণিজ্য হচ্ছে প্রকাশ্যে। তিন ধাপে এ বাণিজ্যগুলো হচ্ছে। প্রথমত মামলার সময়। এরপর মামলা থেকে নাম কাটানোর কথা বলে হয় আরেক দফা বাণিজ্য। জামিন নেয়ার সময়ও হয় বাণিজ্য। সবশেষে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এলে জেলগেটে ফের গ্রেপ্তার করে বাণিজ্য চলে। মামলা বাণিজ্য নিয়ে ৮টি হত্যা মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী ফেনী পৌর বিএনপি’র সদস্য সচিব মেজবাহ উদ্দিন ভূঞা বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতে বিনা খরচে এসব মামলা পরিচালনা করছি। মামলা বাণিজ্য, হত্যা মামলাগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে অন্য মামলাগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এগুলো বাদিরাই ভালো জানেন। মামলা বাণিজ্যের অভিযোগে আদালত এলাকায় কয়েক দফা বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা।