
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশ সংস্কারের যে প্রক্রিয়া শুরু হয় পুলিশ সংস্কার কমিশন তার মধ্যে অন্যতম। এই কমিশনের দেওয়া সুপারিশগুলো জনবান্ধব পুলিশিং, জবাবদিহিতা ও মানবাধিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে নেওয়া হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন চলছে কচ্ছপগতিতে। পুলিশে আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন, নতুন আইন প্রণয়ন এবং কাঠামোগত পরিবর্তনে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনও ঝুলে আছে।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের সভায় এসব সুপারিশের অগ্রগতি ও সীমাবদ্ধতাগুলো পর্যালোচনা করা হয়। সভার দায়িত্বশীল সূত্রগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনে পৃথক হেল্পলাইন নয়, ৯৯৯ শক্তিশালীকরণ
পুলিশের মাধ্যমে সংবিধান, আইন বা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তাৎক্ষণিক প্রতিকারের জন্য কমিশন নতুন হেল্পলাইন বা ৯৯৯-এ বিশেষ সেবার সুপারিশ করেছিল। তবে, পুলিশ অধিদপ্তর আলাদা হেল্পলাইন চালুর পরিবর্তে বর্তমান জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ শক্তিশালীকরণের পক্ষে মত দিয়েছে। বর্তমানে ৯৯৯-এর সক্ষমতা ১০০টি ওয়ার্ক স্টেশন, যা বাড়িয়ে ৫০০টিতে উন্নীত করার জন্য ৫৫২.১০ কোটি টাকার ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) গত ২৯ জুন সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পূর্বাঞ্চলে নতুন ১০০টি ওয়ার্কস্টেশন বাস্তবায়ন এবং পুরোনো ১০০টি আপগ্রেডেশনের জন্য ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
ব্রিটিশ আমলের পুলিশ আইন ১৮৬১, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এবং পিআরবি ১৯৪৩ সংস্কার ও হালনাগাদের সুপারিশ করেছিল কমিশন। সভায় এই আইনগুলো যুগোপযোগী করার বিষয়ে সকলে একমত হন। তবে, আইনগুলোর আন্তঃসম্পর্কের কারণে এর পরিবর্তন সহজসাধ্য নয়। ইতোমধ্যে বলপ্রয়োগ ও মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর কয়েকটি ধারা পরিবর্তনের প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাঠানো হয়েছে

এছাড়া, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর অতীত কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অব.) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দুল হাফিজকে আহ্বায়ক করে একটি সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন
জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করতে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর সুরক্ষার জন্য একটি আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছিল কমিশন। এই বিষয়ে ‘ডিসক্লোজার অব পাবলিক ইন্টারেস্ট ইনফরমেশন অ্যাক্ট ২০১১’-এ সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকলেও পৃথক আইন প্রণয়নের জন্য গত ১৯ জুন আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
তিন আইন হালনাগাদে বিশেষজ্ঞ কমিটি
ব্রিটিশ আমলের পুলিশ আইন ১৮৬১, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এবং পিআরবি ১৯৪৩ সংস্কার ও হালনাগাদের সুপারিশ করেছিল কমিশন। সভায় এই আইনগুলো যুগোপযোগী করার বিষয়ে সকলে একমত হন। তবে, আইনগুলোর আন্তঃসম্পর্কের কারণে এর পরিবর্তন সহজসাধ্য নয়। ইতোমধ্যে বলপ্রয়োগ ও মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর কয়েকটি ধারা পরিবর্তনের প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাঠানো হয়েছে। আইনগুলো পর্যালোচনা ও পরিবর্তনের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি, ‘The Code of Criminal Procedure (Second Amendment) Ordinance, ২০২৫’ জারি হয়েছে।
আটক বা রিমান্ডে নেওয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচের ঘেরাটোপ দেওয়া আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ (Interrogation room) রাখার সুপারিশ করেছিল কমিশন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কেবল নির্মীয়মাণ ও নতুন থানাসমূহে এ ধরনের কক্ষ স্থাপন করা হবে। অন্যান্য পুরোনো থানায় এ ধরনের কক্ষ স্থাপনের বিষয়টি আশু বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মত দেওয়া হয়েছে

ভাসমান থানাতেও ‘না’, নৌ-পুলিশ শক্তিশালীকরণে জোর
বরিশাল, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, খুলনা, ভোলাসহ সমগ্র দেশে আনুমানিক ২৪,১৪০ (প্রায়) বর্গকিলোমিটার জলপথবেষ্টিত এলাকা নৌ-নেটওয়ার্কভুক্ত রয়েছে। এই অঞ্চলের নদীপথে দস্যুতা, চোরাচালান ও মানবপাচার দমনের লক্ষ্যে কমিশন নৌ-নেটওয়ার্কভুক্ত এলাকায় ‘ভাসমান থানা’ গঠনের সুপারিশ করেছিল। তবে, সভায় ভাসমান থানা না করে বিদ্যমান নৌ-ফাঁড়িগুলো সুসংগঠিত করা এবং নৌযানসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করে নৌ-পুলিশকে শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কমিশনের সুপারিশের আলোকে নৌ-পুলিশকে শক্তিশালী করার একটি পরিকল্পনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাখিল করবে। এর ভিত্তিতে পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একটি আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে নৌ-পুলিশকে শক্তিশালীকরণপূর্বক এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে, এ বিষয়ে পুলিশ অধিদপ্তরের প্রস্তাব পাওয়া যায়নি, প্রস্তাব প্রাপ্তি-সাপেক্ষে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রতিটি বিভাগে ডিএনএ ল্যাব ও ক্রাইমসিন ইউনিট চালু
আলামত চিহ্নিতকরণ, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পেশাগত জ্ঞান উন্নয়নের জন্য ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরি, ক্রাইমসিন ইউনিট, জালনোট শনাক্তকরণ ইউনিট, পদচিহ্ন, হস্তলিপি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট শাখা এবং অটোমেটেড ডিএনএ ল্যাব স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছিল।

এর বিপরীতে বলা হয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ল্যাব রয়েছে। কমিশনের সুপারিশের আলোকে অবশিষ্ট ছয়টি বিভাগীয় শহরে এসব ফরেনসিক ইউনিটকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘সায়েন্টিফিক ইন্টিগ্রেশন সেন্টার’ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২৯১.৯৬৮৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত মূল্যের ডিপিপি বর্তমানে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াধীন।
স্বচ্ছ কাচের ঘেরাটোপে জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে জটিলতা
আটক বা রিমান্ডে নেওয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচের ঘেরাটোপ দেওয়া আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ (Interrogation room) রাখার সুপারিশ করেছিল কমিশন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কেবল নির্মীয়মাণ ও নতুন থানাসমূহে এ ধরনের কক্ষ স্থাপন করা হবে। অন্যান্য পুরোনো থানায় এ ধরনের কক্ষ স্থাপনের বিষয়টি আশু বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মত দেওয়া হয়েছে।
নারী আসামিকে শালীনতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ; নিয়োগ পাবে আরও ৫০০ নারী এএসআই
নারী আসামিকে যথেষ্ট শালীনতার সঙ্গে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে বলে সুপারিশ করে কমিশন। নারী আসামিকে নারী পুলিশের উপস্থিতিতেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় মর্মে পুলিশ মহাপরিদর্শক সভাকে অবহিত করেন। বিষয়টি অব্যাহত রাখতে হবে এবং এর যেন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সভায় বলা হয়েছে, পুলিশকে অধিকতর জেন্ডার সংবেদনশীল করার লক্ষ্যে প্রতিটি স্তরে পুলিশ সদস্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্স চলমান। এতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গত ২৮ জুলাই ৩১৪ নম্বর স্মারকমূলে মোট ৮০০০ এএসআই-এর মধ্যে ৪০০০ এএসআই নিয়োগের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পাওয়া গেছে। যার মধ্যে নারী এএসআই-এর সংখ্যা ৫০০ জন। এসব পদ সৃজনসহ নিয়োগ ও পদায়ন হলে নারী আসামিদের নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করার বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গত ২৮ জুলাই ৩১৪ নম্বর স্মারকমূলে মোট ৮০০০ এএসআই-এর মধ্যে ৪০০০ এএসআই নিয়োগের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পাওয়া গেছে। যার মধ্যে নারী এএসআই-এর সংখ্যা ৫০০ জন। এসব পদ সৃজনসহ নিয়োগ ও পদায়ন হলে নারী আসামিদের নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করার বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে

নাগরিক নিরাপত্তা বিধানে জরুরি কল সার্ভিস নয়, ৯৯৯ শক্তিশালীকরণ
তল্লাশির সময় পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিতে অস্বীকার করলে বা সার্চ ওয়ারেন্ট না থাকলে নাগরিক নিরাপত্তা বিধানে একটি জরুরি কল সার্ভিস চালু করার সুপারিশ করেছিল কমিশন। তবে, এই প্রস্তাবও বাতিল করা হয়েছে। এর পরিবর্তে ৯৯৯-কে আরও অধিকতর শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত হয়েছে (১০০ ওয়ার্ক স্টেশন থেকে ৫০০টিতে উন্নীত করার প্রস্তাব)। জব্দ করা মালামালের যথাযথ তালিকা না হলে এবং তল্লাশি কার্যক্রমটি সন্দেহজনক মনে হলে তা তাৎক্ষণিক জানানোর জন্য মেট্রো এলাকায় ডেপুটি পুলিশ কমিশনার/জেলা পুলিশ সুপারের বরাবর জরুরি কল সার্ভিস চালু করার সুপারিশের ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জিপিএস ট্র্যাকিং ও বডি ক্যামেরা পরীক্ষামূলক ব্যবহারের প্রস্তাবনা
অভিযান পরিচালনার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইসসহ (বডি-ওর্ন ক্যামেরা) ভেস্ট/পোশাক পরিধান করার সুপারিশ ছিল। এছাড়া, রাতের বেলায় (সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়) গৃহ-তল্লাশির সময় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধির উপস্থিত থাকার কথা সুপারিশ করে কমিশন। এ বিষয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে এর পাইলটিং শুরু হয়েছে। সারা দেশে বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ৪০ হাজার ডিভাইসের প্রয়োজন হবে এবং এ বিষয়ে শিগগিরই প্রস্তাবনা পুলিশ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রেরণ করা হবে। এছাড়া, রাতের বেলায় গৃহ-তল্লাশির সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এফআইআর বহির্ভূত আসামি গ্রেপ্তারের সুপারিশ বাস্তবায়ন হচ্ছে না
কমিশনের সুপারিশ ছিল, কেস ডায়েরি আদালতে দাখিল করে আদালতের আদেশ ব্যতীত কোনোক্রমেই এফআইআর বহির্ভূত আসামি গ্রেপ্তার করা যাবে না। তবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, এক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতিই অধিক কার্যকর। কারণ, আদালতের আদেশের জন্য অপেক্ষা করলে অপরাধীর পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে আরও পর্যালোচনার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া, মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ উঠলে তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া কথা বলা হয়েছে।

পুলিশ সার্ভিসের পুলিশ সুপার (এসপি) ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পদায়নের জন্য নিয়মিত বিরতিতে ফিটলিস্ট প্রস্তুত ও হালনাগাদ করার সুপারিশের ভিত্তিতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতামত
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো আসলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার একটি রূপরেখা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনিক অনুমোদন ও অর্থায়নের জটিলতায় এসব সুপারিশের বাস্তবায়ন হচ্ছে কচ্ছপগতিতে। আমরা প্রায় এক দশক ধরে বলছি, পুলিশ রিফর্ম শুধু ইউনিফর্ম বা কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয় নয়, এটি মূলত শাসনব্যবস্থা ও নাগরিক আস্থার সঙ্গে জড়িত।’
‘কমিশনের সুপারিশগুলো, বিশেষ করে ফৌজদারি কার্যবিধির হালনাগাদ, ফরেনসিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, জিপিএস ও বডি ক্যামেরা চালু— এসব বিষয় বাংলাদেশের নিরাপত্তা কাঠামোতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারত। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি এখনও অনেক সুপারিশ পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।’
তল্লাশির সময় পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিতে অস্বীকার করলে বা সার্চ ওয়ারেন্ট না থাকলে নাগরিক নিরাপত্তা বিধানে একটি জরুরি কল সার্ভিস চালু করার সুপারিশ করেছিল কমিশন। তবে, এই প্রস্তাবও বাতিল করা হয়েছে। এর পরিবর্তে ৯৯৯-কে আরও অধিকতর শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত হয়েছে (১০০ ওয়ার্ক স্টেশন থেকে ৫০০টিতে উন্নীত করার প্রস্তাব)

এ বিষয়ে নিজের পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার তখনই ফলপ্রসূ হয়, যখন তার সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়সীমা, পর্যবেক্ষণ সূচক ও জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা যুক্ত থাকে। বর্তমানে যেভাবে বিভিন্ন দপ্তরে আলাদা আলাদা কমিটি গঠিত হচ্ছে, তাতে সমন্বয়ের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। আমার মতে, সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং টাস্কফোর্স থাকা উচিত, যারা প্রতি ছয় মাসের অগ্রগতির প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। তা না হলে এই উদ্যোগও নথিপত্রে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পুলিশ সংস্কারের যাত্রা শুরু হয়েছিল মানুষের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার চিন্তা থেকে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ সুপারিশই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বা প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেখানে মানবাধিকার ও নাগরিক সুরক্ষার মূল লক্ষ্যটি গৌণ হয়ে পড়েছে।’
উদাহরণ টেনে তিনি আরও বলেন, “কমিশনের প্রস্তাব ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকারের জন্য আলাদা হেল্পলাইন অথবা থানায় স্বচ্ছ কাচের ঘেরাটোপ দেওয়া আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ (Interrogation room) রাখা। এগুলো কার্যকর হলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও ন্যায্যতার নিশ্চয়তা অনেকটাই নিশ্চিত হতো। কিন্তু সভায় এসব প্রস্তাব ‘এখনই বাস্তবায়নযোগ্য নয়’ বলে বাতিল হয়েছে, নয়তো অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে।”
কমিশনের সুপারিশ ছিল, কেস ডায়েরি আদালতে দাখিল করে আদালতের আদেশ ব্যতীত কোনোক্রমেই এফআইআর বহির্ভূত আসামি গ্রেপ্তার করা যাবে না। তবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, এক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতিই অধিক কার্যকর। কারণ, আদালতের আদেশের জন্য অপেক্ষা করলে অপরাধীর পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে
‘এখানে প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্র কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে পুলিশি জবাবদিহিতাকে মানবাধিকারের অংশ হিসেবে দেখার?’
তিনি আরও বলেন, “আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশে মানবাধিকার সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো ‘প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতার অভাব’। পুলিশ সংস্কার কমিশন যদি সত্যিই কার্যকর করতে হয়, তাহলে শুধু প্রশাসনিক নোটশিট নয়, বরং জনসম্পৃক্ত তদারকি ব্যবস্থাও যুক্ত করতে হবে।”
“সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানবিক পুলিশ গঠন। কিন্তু তার বাস্তব রূপ এখনও দূরের স্বপ্ন। তাই আমি বলব, যতক্ষণ পর্যন্ত সংস্কারের মাপকাঠি হবে ‘মানুষের নিরাপত্তা ও মর্যাদা’, ততক্ষণ পর্যন্ত এই উদ্যোগের তাৎপর্য বজায় থাকবে। অন্যথায় এটি আরেকটি প্রশাসনিক চক্রেই হারিয়ে যাবে।”