
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ বিশেষ ক্ষমতা দেখিয়ে সে সময়ের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন করে। ব্যাংকটিতে শুরু হয় অবৈধ নিয়োগ কার্যক্রম। নিয়োগ পাওয়া বেশিভাগ কর্মকর্তাই একটি এলাকাকেন্দ্রিক। যাদের অনেকের ছিল না ন্যূনতম যোগ্যতা, দক্ষতা, এমনকি ভদ্রতাও। এস আলমসহ বিভিন্ন শিল্প মালিক ও নেতার সুপারিশে নিয়োগ পাওয়ায় কর্মীরা দেখাতেন আলাদা দাপট।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অবৈধকে ‘অবৈধ’ মেনে নিতে হবে নাহলে শৃঙ্খলা হারাবে ব্যাংকটি। এছাড়া অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের দেওয়া বেতন-ভাতা আইনি দৃষ্টিতে বৈধ নয়। তাই এসব অর্থ ফেরত পেতে ব্যাংকের আদালতে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন।
সম্প্রতি ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া এসব কর্মীর মূল্যায়ন পরীক্ষা নিতে গেলে বাধে বিপত্তি। ব্যাংকগুলোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন সেই অবৈধ কর্মকর্তারা।
কর্মী ছাঁটাই ও মূল্যায়ন পরীক্ষা প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ওমর ফারুক খান জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের কোনো এলাকা বা ব্যক্তির প্রতি ক্ষোভ নেই। আসলে আমরা কিন্তু কর্মী ছাঁটাই করিনি। আপনারা জানেন ’১৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যাদের নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে এদের কারও নিয়োগ প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না। নিয়োগপ্রাপ্ত এসব কর্মীর মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম জেলাতেই সাত হাজার ২২৪ জন।
সম্প্রতি তাদের মূল্যায়ন পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। পরীক্ষায় ৮৮ শতাংশ কর্মকর্তা উত্তীর্ণ হয়। যারা মূল্যায়ন পরীক্ষায় অংশ নেননি, ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে অনেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে এমন কিছু কর্মর্কতা রয়েছে যারা ব্যাংকের গ্রাহকদের আস্থা হারিয়েছে শুধুমাত্র তাদের চাকরিচ্যুত ও ওএসডি করা হয়েছে। এদের মধ্যে থেকে কেউ যদি চাকরিতে পূণর্বহাল হয়, তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার সুযোগ নেই।
পতিত হাসিনা সরকারের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন সাইফুল আলম (এস আলম)। তাকে ব্যাংক দখলের অবাধ সুযোগ করে দেওয়া হয় তৎকালীন গণভবন থেকেই। এরপর থেকেই চর দখলের মতো দখল হয় সাত ব্যাংক। দখলকৃত ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ পাওয়া ৩১ হাজার কর্মীর বেশিরভাগের বাড়ি এস আলমের নিজ উপজেলা পটিয়ায়। তার বাড়ির সামনে রাখা ‘জাদুর বাক্সে’ সিভি ড্রপ করেই এদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এর বাইরে সাবেক একজন গভর্নরের সুপারিশে এস আলম আরও ২৯০০ লোক নিয়োগ দেন বলে জনশ্রুতি আছে। মূলত সেই গভর্নরই দুই হাত খুলে এস আলমের ব্যাংক দখলের অনুমতি, ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার সুযোগসহ উদার হস্তে সবই দিয়ে গেছেন।
ইসলামী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ২১ হাজার। এর মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয় প্রায় ১১ হাজার। এদের বেশিরভাগেরই কোনো ধরনের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ কিংবা মূল্যায়ন পরীক্ষাও নেওয়া হয়নি। এসব কর্মীর মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম জেলার সাত হাজার ২২৪ জন। যার মধ্যে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের নিজ উপজেলা পটিয়ার বাসিন্দা চার হাজার ৫২৪ জন। ওই সময় ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকার সময় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশে ‘অবৈধভাবে’ নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের পেছনে বছরে প্রতিষ্ঠানটির খরচ হচ্ছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এই হিসাবে ২০১৭ সালে ব্যাংকটি এস আলমের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ‘অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত’দের বেতন-ভাতায় খরচ হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বিভিন্ন নথি বিশ্লেষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ গত ১৪ আগস্ট পরীক্ষার তারিখ ২৯ আগস্ট নির্ধারণ করে। পরে ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার মো. হানিফ ২৭ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করলে আদালত বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ পর্যালোচনা করে ২৫ সেপ্টেম্বর জানায়, ইসলামী ব্যাংক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তাই কর্মীদের চাকরি, নিয়োগ ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া তাদের নিজস্ব এখতিয়ারে। তবে সিদ্ধান্তগুলো অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানের মধ্যে হতে হবে।
এ সিদ্ধান্তের আলোকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা গ্রহণ করে, যা গত শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোট ৫ হাজার ৩৮৫ কর্মীর অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৪১৪ জন অংশ নেন এবং তারা নিয়মিত অফিসও করেছেন। তবে বাকি ৪ হাজার ৯৭১ জন পরীক্ষা এড়িয়ে পরদিন অফিসে হাজির হন। এদের মধ্যে ২০০ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং বাকি ৪ হাজার ৭৭১ জনকে তাদের কাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
পরীক্ষা আয়োজনের আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংক থেকে একটি নোটিস জারি করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক বলে জানানো হয়। তবে পরীক্ষার দিন বহু কর্মী পরীক্ষায় না বসে বর্জন কর্মসূচি পালন করেন। তারা সংবাদ সম্মেলন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে পরীক্ষার বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। আদালতের নির্দেশনা যথাযথভাবে মানা হয়নি দাবি করে তারা বলছেন, হাইকোর্ট নিয়মিত প্রোমোশনাল পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নতুন করে বিশেষ পরীক্ষার আয়োজন করেছে, যা আদালতের আদেশের পরিপন্থি।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘কর্মীদের মান যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা নেওয়া বাংলাদেশে নতুন অভিজ্ঞতা। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে, যদি ব্যাংকের নীতিমালায় পরীক্ষা নেওয়ার বিধান থাকে, তবে তারা তা করতে পারবে। ফলে বিষয়টি এখন আদালত ও ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে সীমাবদ্ধ।’
কর্মীদের ছাঁটাই ও কাজ থেকে বিরত রাখা প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যারা পরীক্ষায় অংশ নেয়নি চাকরিবিধি ভঙ্গ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০০ কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৪ হাজার ৯৭১ জন কর্মীকে ওএসডি (অন সার্ভিস ডিউটি) করা হয়েছে। ওএসডি হওয়া কর্মীরা বেতন-ভাতা ঠিকই পাবেন, কিন্তু কোনো দায়িত্ব বা কর্মস্থলে থাকবে না।
তবে পরীক্ষায় অংশ না নেওয়া কর্মকর্তাদের একটি অংশ অভিযোগ করেছেন, আদালতের স্থগিতাদেশ অমান্য করে পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে। এ কারণে তারা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন।
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্বে থাকা ড. কামাল উদ্দীন জসীম বলেন, ‘নিয়োগ নীতিমালা অনুসরণ না করে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত অনেককে নিয়োগ দেওয়া হয়। এমন কর্মীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর মাধ্যমে মূল্যায়ন পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। যারা অংশ নেয়নি তাদের ওএসডি করা হয়েছে। আর চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে সামাজিক মাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় লেখালেখি করেছে এমন কিছু কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব কর্মীর অনেকের একাডেমিক সনদ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে সবার সনদ যাচাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হলে বিজিসি ট্রাস্ট ও পোর্টসিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।’
এর আগে গত রবিবার চট্টগ্রামের পটিয়ায় ইসলামী ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে মামলাও হয়েছে। এতে অজ্ঞাত পরিচয় ২৫০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, রবিবার সকালে ইসলামী ব্যাংকের পুনঃনিরীক্ষণ পরীক্ষা বয়কট ও চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। ওই সময় কয়েক কর্মকর্তা পটিয়া শাখায় কাজে যোগ দিতে গেলে তারা বাধা দেন। একপর্যায়ে তারা ব্যাংক ম্যানেজারের কক্ষে প্রবেশ করেন।
শুধু ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশেই নয়, অবৈধ নিয়োগ নিয়ে আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংকে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করেন অবৈধ কর্মকর্তারা। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন তদারক সংস্থার তদন্তে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন অসঙ্গতি সামনে চলে আসে। বিষয়টি নিয়মের মধ্যে আনার লক্ষ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এর অংশ হিসেবে চিহ্নিত ১৪১৪ কর্মকর্তার মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর মধ্যে অকৃতকার্য ৫৪৭ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এই চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা গত ২৮ জুলাই সকালে আকস্মিক আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের হেড অফিসের প্রবেশমুখে জড়ো হন। তারা বল প্রয়োগ করে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। শত শত কর্মীর কর্মক্ষেত্রকে তারা ঝুঁকির মধ্যে ফেলেন। পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপে তারা পিছু হটেন।
সোমবার রাজধানী দিলকুশাসহ ইসলামী ব্যাংক শেয়ার হোল্ডার ফোরাম সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। এতে তারা এস আলম ও চট্টগ্রামের অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্তদের দ্রুত অপসারণের জন্য ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। এ সময় বক্তারা বলেন, এস আলম নিজ বাড়িতে বাক্স বসিয়ে অবৈধভাবে ইসলামী ব্যাংকে পটিয়া ও চট্টগ্রামের চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি দিয়ে ব্যাংকের সেবার মান ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা গ্রাহকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে।
কোনো সেবা চাইলে তারা ঠিকমত সেবা দিতে পারেন না। তারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন যা আমরা বুঝতে পারি না। এ ধরনের অযোগ্য লোক দিয়ে ইসলামী ব্যাংক চালানোর চেষ্টা করলে অবিলম্বে গ্রাহকরা এ ব্যাংক ছেড়ে দেবে। তাই এ ধরনের কর্মকর্তাদের অবিলম্বে বহিষ্কার করতে হবে।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, দেশের ৬৩টি জেলার চাকরিপ্রার্থীদের বঞ্চিত করে একটি জেলার প্রার্থীদের গোপনে নিয়োগ দিয়ে ব্যাংকের শৃঙ্খলা চরমভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।