
দেশটাকে লুটেপুটে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। তখন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ছিল অনেকটাই বিপর্যস্ত। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুতির আগে ব্যয় মেটাতে সরকার ঋণ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু গত এক বছরেও রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে কিছুটা অগ্রগতি ছাড়া বিপর্যয় সামাল দিতে পারেনি। যদিও গত দু’মাসে পোশাক খাতের রফতানি আয় পড়তির দিকে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত এলসির কারণে আগামী দিনে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে এমন নিয়ামক মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি নেই বললেই চলে। এই সময়ে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়েনি, বরং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে কমেছে।
গত এক বছরে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে বেকার হয়েছেন এসব কারখানায় কর্মরত এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিক। এদিকে নতুন করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে না। যাও গড়ে উঠেছে তাও খুবই সীমিত। এমনকি আগের ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি নেই, নতুন পণ্য নেই। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, আরো কিছু বন্ধের পথে।
এদিকে এখনও যেসব গার্মেন্টস কারখানা চালু আছে তারাও জ্বালানি সমস্যা, কাস্টমসের হয়রানি এবং সরকারের নানাবিধ অমূলক সিদ্ধান্তের অভাবে বিপাকে। বেক্সিমকোর মতো বড় পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে আবার পোশাকের সঠিক দাম পাচ্ছে না, উৎপাদন খরচ বাড়লেও বায়াররা পণ্যের দাম না বাড়িয়ে বরং কমানোর চাপ দিচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি ক্রেতারা তৈরী পোশাকের দাম কমানোর জন্য বাংলাদেশি রফানিকারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন, যা প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতির কারণে উদ্ভূত হয়েছে। যা আগামী দিনে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে এই খাতকে। এই পরিস্থিতিতে ক্রেতারা পোশাকের দাম কমাতে বা অতিরিক্ত শুল্কের অংশ বহন করতে বলছেন, যা রফতানিকারকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ এটি তাদের উৎপাদন ব্যয় এবং মুনাফার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। ইতোমধ্যে যার প্রভাবে টানা দু’মাস ধরে দেশের পণ্য রফতানি কমছে। গত আগস্টে রফতানি কমেছিল প্রায় ৩ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বরে রফতানি কমেছে ৪ দশমিক ৬১।
এদিকে কারখানা বন্ধসহ কাজ না থাকায় শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিছু শ্রমিক জীবিকার তাগিদে আগের চেয়ে কম বেতনে চাকরি পেলেও হাজার হাজার শ্রমিক এখনো বেকার। অনেকেই চাকরি না পেয়ে চা দোকানে কাজ করছেন। কেউ টিকিট কাউন্টারে, কেউবা অটোরিকশা চালাচ্ছেন, বাজারে সবজি বিক্রি করছেন কেউ কেউ। তবে অনেকেই আবার কাজ না পেয়ে ডাকাতি, অপহরণ ও ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়েছেন। এসব শ্রমিক নানাবিধ অপরাধ এবং উপায় না পেয়ে জীবিকার তাগিদে অনেকে অনাকাক্সিক্ষত পেশা বেছে নিচ্ছেন। এমনকি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে ডাকাতির মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনাও ঘটছে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান না থাকায় দেশে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েই চলেছে। হত্যা ও ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তারা।
পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই বছরে ৩৭ শতাংশ বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা। যৌথ বাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের সাঁড়াশি অভিযানেও থামানো যাচ্ছে না এসব অপরাধ কর্মকা-। মাধ্যমিকের নিচে পড়ালেখা করা বেকারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৭ হাজারে। যাদের বেশিরভাগই শ্রমিক। তাদের বেকারত্ব বেড়েছে ০ দশমিক ৫১ শতাংশ পয়েন্ট। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি খাতে প্রত্যাশিত হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়নি। ব্যবসার সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিও সীমিত পর্যায়ে আছে। ড. ফাহমিদা বলেন, চাকরির প্রকৃত উৎস মূলত সরকার, কিন্তু সেই সুযোগ সংখ্যায় সীমিত এবং প্রতি বছর আসে না। এ অবস্থায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধির আশা করা বাস্তবসম্মত নয়।
এদিকে চার শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দুই হাজারের বেশি ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এতে অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। বিপদ এড়াতে আবার অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। সব মিলিয়ে ত্রাহি অবস্থার মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছে দেশের আর্থিক খাত। শুধু দেশীয় নানা সীমাবদ্ধতায়ই পোশাক খাতের বিপর্যয় নয়; নতুন সংকট যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতি। এর প্রভাবে দেশের তৈরী পোশাক রফতানি কমেছে জানিয়ে বিকেএমই-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা অতিরিক্ত ২০ শতাংশ রেসিপ্রোক্যাল শুল্কের একটি অংশ বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। রফতানিকারকদের পক্ষে এই বাড়তি চাপ বহন করা সম্ভব নয়। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও শুল্ক সমন্বয়ের চাপ তারা আগেই সামলাচ্ছেন। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য বাজারেও কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এসব বাজারে রফতানি বাড়াচ্ছে। এই ধীরগতি আরো দুই থেকে তিন মাস থাকতে পারে জানিয়ে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন শুল্ক কাঠামোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে রফতানি পুনরুদ্ধার হবে। এ সময় তিনি রফতানিকারকদের ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, গত দু’মাসে পোশাক খাতের রফতানি কমা মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার ধীরগতি এবং মূল্য প্রতিযোগিতার কারণে। এ থেকে উত্তোরণে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
অবশ্য দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট ও সঠিক নীতির অভাবে আস্থা সংকটে উদ্যোক্তারা, গতি নেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেÑ এই বাস্তবতা এখন দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগেও যখন দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন কারখানা স্থাপন, ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা প্রযুক্তি খাতে বড় উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন অর্থনীতির মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ থেকে সরে আসছেন, পুরনো বিনিয়োগ ধরে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন। আদালত-মামলার জট, প্রশাসনিক হয়রানি, নীতির অস্থিরতা, জ্বালানি সংকট এবং নিরাপত্তাহীনতাÑ সবকিছু মিলে ব্যবসায়ীরা আস্থাহীনতার এক দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছেন। এই অবস্থা থেকে বের হতে না পারলে দেশের প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, রফতানিÑ সবকিছু থেমে যাবে, অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থবিরতার দিকে চলে যাবে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত সপ্তাহে প্রকাশিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে উঠে এসেছে, দেশে এখনও স্নাতক ডিগ্রিধারীদের প্রতি তিনজনের একজন বেকার। এতে বলা হয়, দেশে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, বেড়েছে বেকারের সংখ্যা। এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ ৬০ হাজার। তাদের বেশিরভাগই আবার উচ্চশিক্ষিত। যোগ্যতা অনুসারে চাকরি পাচ্ছে না মানুষ। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের চিত্র ভয়াবহ। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী যুব বেকারদের মধ্যে প্রায় ২৯ শতাংশ স্নাতক। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শ্রমবাজারে নিরক্ষর শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৩০ লাখে। এই নিরক্ষর কর্মশক্তি দেশের অর্থনীতির উৎপাদনশীলতায় তৈরি করছে বড় সীমাবদ্ধতা। বিশেষ করে শিল্প ও সেবা খাতে দক্ষতা ঘাটতির কারণে অনেকে কাজ পেলেও যোগ্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। কর্মসংস্থানের কাঠামোতেও বড় বৈষম্য ধরা পড়েছে। দেশে কাজে নিয়োজিতদের ৮৪ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে। গ্রামে এ হার ৮৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ, শহরে ৭৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ বিপুল শ্রমশক্তি এখনো সুরক্ষাহীন, সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত।
দেশের রফতানিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরী পোশাক শিল্পে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব, ঋণের বোঝা, শ্রমিক অসন্তোষসহ আরো কিছু সমস্যায় টালমাটাল এই খাত। এতে বেকার হয়ে পড়ছেন লাখো শ্রমিক। শুধু পোশাক খাত নয়, অন্যান্য খাতের কারখানাও বন্ধ হচ্ছে।
কারখানা বন্ধ হওয়া এবং শ্রমিকের চাকরি হারানোর প্রবণতা ও অপরাধে জড়ানোয় দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। একই সময়ে নতুন কারখানা চালুর আশাব্যঞ্জক প্রবণতা দেখা গেলেও তা সংকট কাটানোর মতো পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা ধরে রাখার কৌশল পুনর্গঠন করা দরকার। অন্যথায় বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত ধাক্কা খেতে পারে। একই সঙ্গে অন্যান্য খাতের কারখানাও হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ জন্য খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলোÑ বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার তুলনায় নতুন কর্মসংস্থান যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব সরাসরি শিল্পের ওপর পড়ছে। এ ছাড়া ঋণ ও কার্যাদেশের সংকট ব্যবসায়িক ধারাবাহিকতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, কর্মসংস্থান না থাকা এবং গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকরা কাজ না থাকায় জীবিকার তাগিদে অপরাধে জড়াচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীরা শিশু-কিশোরদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ‘কিশোর গ্যাং’ তৈরি করছে। পুলিশ তাদের গ্রেফতার বা উন্নয়নকেন্দ্রে পাঠালেই সব সমাধান হবে না। এ জন্য পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। রাতারাতি এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
তৈরী পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠনের (বিজিএমইএ) তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন করে ১৬৫টি কারখানা সদস্যপদ লাভ করেছে, যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৯৭ হাজার ৮৬৬ জনের। এসব কারখানাও যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত ২০ শতাংশ রেসিপ্রোক্যাল শুল্কের চাপে বিপর্যস্ত। এ ব্যাপারে বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ থেকে রফতানির ওপর গড় এমএফএন (মোস্ট ফেভারড নেশন) শুল্ক ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং এই ট্রাম্পের নতুন ধার্য ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক মিলিয়ে মোট শুল্কের পরিমাণ প্রায় ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তিনি বলেন, কারখানা খোলা ও বন্ধ হওয়া চলমান প্রক্রিয়া। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। অনেক মালিক দেশে না থাকায় কারখানা সঠিকভাবে দেখভাল করা যায়নি। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। একই সঙ্গে অনেক কারখানা নতুন হয়েছে। তবে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোর অর্ধেক শ্রমিক কাজ পান না।
অন্যদিকে শিল্প পুলিশের তথ্য ভিন্ন বাস্তবতা তুলে ধরেছে। তাদের হিসাবে, গত এক বছরে পোশাক কারখানাসহ ২৫৮টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে, যেখানে এক লাখ চার হাজার শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে ৫৭টি কারখানা সরাসরি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বন্ধ হয়েছে, যেগুলোর মালিক আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ী ছিলেন। যদিও কারখানা বন্ধের মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও মালিকদের বিদেশে অবস্থান; ব্যাংকঋণের জটিলতা; বৈদেশিক ক্রেতাদের কার্যাদেশ না পাওয়া, ঋণপত্র (এলসি) জটিলতা এবং শ্রমিক অসন্তোষ। এই বহুমাত্রিক সংকটের কারণে মালিকরা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। গত এক বছরে ১৩০টি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এখনো ৩৪টি কারখানায় অস্থিরতা চলমান। মজুরি কাঠামো, বকেয়া বেতন, কর্মপরিবেশের মান এবং রাজনৈতিক প্রভাব এই অসন্তোষকে তীব্র করছে। যদিও নতুন কারখানা চালুর সংখ্যাও আশাবাদ জাগায়। ভবিষ্যতে শ্রমবাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এই প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সঠিক নীতি সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা ধরে রাখার কৌশল জরুরি।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, পোশাক খাতে একটি স্থায়ী অস্থিরতা চলছে। এরই মধ্যে দ্ইুশ’র বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অথচ বর্তমান প্রেক্ষাপটে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কথা, কারণ বৈশ্বিক বাজারে রফতানির চাহিদা বাড়ছে। এই সময়ে যদি রফতানি ব্যাহত হয়, তাহলে সার্বিকভাবে দেশের মাইক্রো অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কর্মহীন মানুষের সংখ্যা আরো বাড়বে। এ জন্য সরকারের উচিত সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে জরুরি সংলাপ। একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোকে নীতির আওতায় এনে কর্মহীন শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।