Image description

পাবর্ত্য জেলা খাগড়াছড়ির পানছড়ির দুর্গম এলাকায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইউপিডিএফ’র একটি গোপন আস্তানায় হানা দিয়ে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।
সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল সোমবার ভোরে পানছড়ি উপজেলার যুবনেশ্বর পাড়া এলাকার গভীর জঙ্গলে সেনাবাহিনীর একটি অভিযানিক দল ইউপিডিএফ’র একটি গোপন আস্তানা ঘেরাও করে অভিযান চালায়। আইএসপিআর জানায়, অভিযান চলাকালে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে ইউপিডিএফ’র শীর্ষ স্থানীয় গ্রুপ কমান্ডার সুমেন চাকমা পালিয়ে যায়। পরে সেখানে তল্লাশি চালিয়ে ইউপিডিএফ সশস্ত্র সদস্যদের ব্যবহৃত একটি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, দুই রাউন্ড এ্যামোনিশন, ১৫টি ব্যানার, দুইটি ওয়াকিটকি চার্জার, দুইটি মোবাইল ফোন, ধারালো অস্ত্র এবং বেশ কিছু সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়।

অভিযান চলাকালে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ব্যাহত করতে ইউপিডিএফ স্থানীয় নারী-পুরুষ, ছাত্র ও ছাত্রীদের সেনাবিরোধী সেøাগান দিতে বাধ্য করে। এ ঘটনাসহ বিগত কয়েকদিনের ঘটনা প্রবাহ পর্যবেক্ষণে এটি স্পষ্ট, ইউপিডিএফ এবং তার অঙ্গসংগঠনসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে এলাকার নারী এবং স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের বিভিন্ন পন্থায় তাদের নাশকতামূলক কর্মকা-ে অংশগ্রহণে বাধ্য করছে।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে পালিয়ে যাওয়া ইউপিডিএফ’র সশস্ত্র সদস্যদের সন্ধানে সেনা অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং এ অঞ্চলের সকল জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে এক মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে সংঘাত-সহিংসতা ও দাঙ্গার ঘটনায় উসকানিদাতাদের খুঁজছে পুলিশ। গত ২৭ এবং ২৮ সেপ্টেম্বর সংঘঠিত সহিংসতায় তিনজনকে হত্যা এবং ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। এসব মামলার আসামিদের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যারা ওই সহিংসতায় উসকানি দিয়েছেন তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, মাইকেল চাকমাসহ ওই সংঘাতের ঘটনায় যারা উসকানি দিয়েছেন সরাসরি অংশ নিয়েছেন তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।

গেল মাসের শেষ দিকে এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে বিচ্ছিন্নতাবাদি গোষ্ঠী ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি জেলা সদর এবং গুইমারা উপজেলায় সহিংসতায় জড়ায়। সন্ত্রাসীরা বাঙ্গালীদের বাড়ি ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়। রাস্তা বন্ধ করে সড়কে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। এই ঘটনায় জড়িতের ধরতে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। এই ঘটনায় যারা উসকানি দিয়েছেন তাদেরও চিহ্নিত করার কাজ চলছে। সন্ত্রাসীদের গুলিতে তিনজন নিহত হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদি গোষ্ঠী পাহাড়কে ঘিরে দেশবিরোধী যে চক্রান্তে লিপ্ত, ওই তিন খুনের ঘটনা তারই ধারাবাহিকতা। ওই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে আগেও অনেকে খুন হয়েছে। সাধারণ পাহাড়ি বাঙ্গালীর পাশাপাশি অনেক রাজনৈতিক নেতাও খুন হয়েছেন। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা এবং তপন জ্যোতিসহ (বর্মা) একাধিক রাজনৈতিক নেতার নৃশংস হত্যাকা- এখনো মানুষের মনে রয়ে গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, এইসব খুনের ঘটনা জনসমক্ষে এলেও, এর নেপথ্যের মূল পরিকল্পনাকারী মাইকেল চাকমা এখনও ধরা ছোয়ার বাইরে।

১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য রাজনীতিতে জন্ম নেয় ইউপিডিএফ, যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রসীত বিকাশ খীসা। এই নতুন রাজনৈতিক সংগঠনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন মাইকেল চাকমা। অপরদিকে, একই উপজাতি গোষ্ঠীর আরেক পরিচিত নেতা শক্তিমান চাকমা বেছে নেন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ। এই দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয় ২০১১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। সে সময় চাঁদাবাজি, অস্ত্র চোরাচালানসহ ১৮টি মামলার দায়ে পতেঙ্গা থেকে অস্ত্রসহ মাইকেল চাকমাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এই গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে মাইকেল চাকমার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ একরকম ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

অন্যদিকে, এই সুযোগে রাজনীতিতে ক্রমশ মূল নেতা হিসেবে সামনে আসেন শক্তিমান চাকমা। তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, এবং তিনি নানিয়ার চর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। স্থানীয়রা জানান, ক্ষমতার এই পট পরিবর্তন মাইকেল চাকমার মনে গভীর ক্ষোভ ও প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। মাইকেল চাকমার নেতৃত্ব ফিরে পাওয়ার এবং ক্ষমতাকে পাকা পোক্ত করার একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ান শক্তিমান চাকমা।

২০১৮ সালের ৩ মে সকালে উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা নানিয়ারচর উপজেলা কমপ্লেক্স গেইটের ভিতরে পৌঁছা মাত্র আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা সশস্ত্র সদস্যরা তাকে গুলি করে। এই হামলার মাধ্যমে জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকা- পুরো পার্বত্য অঞ্চলে গভীর আতঙ্ক ও অস্থিরতা তৈরি করে। নৃশংসতার এখানেই শেষ ছিল না। হত্যাকা-ের পরদিন ৪ মে তার শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য তপন জ্যোতি (বর্মা)সহ ১২ জনের দল মাইক্রোবাসযোগে খাগড়াছড়ি থেকে নানিয়ারচর যাওয়ার পথে বেতছড়ি নামক স্থানে পৌঁছা মাত্রই রাস্তার পাশে ওৎ পেতে থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়ে। এসময় চালকের হাতে গুলি লাগায় মাইক্রোবাসটি রাস্তার পাশে উল্টে পরে গেলে সশস্ত্র সদস্যরা কাছে এসে গুলি করলে তপন জ্যোতি (বর্মা)সহ তিনজন ঘটনাস্থলে মারা যায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৯ মে শক্তিমান চাকমার বন্ধু ও সহকর্মী রূপস চাকমা বাদী হয়ে মাইকেল চাকমাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে নানিয়ারচর থানায় মামলা করেন। একজন নেতা যখন নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নিজ জাতির আরেক নেতা এবং নিজ দলের সহকর্মীদের হত্যা করতে পারে, তখন পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মাইকেল চাকমা আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে মতবিরোধের ফলে গুমের শিকার হন। পরবর্তীতে গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি ছাড়া পান। অভিযোগ রয়েছে, গুমের বিষয়কে পুঁজি করে দেশবাসীর সহমর্মিতাকে কাজে লাগিয়ে পুনরায় ইউপিডিএফ’র মাস্টারমাইন্ড হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে নাশকতার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে লিপ্ত রয়েছেন এবং বিভিন্ন নিউজ মিডিয়া ও চ্যানেলে নিজেকে ভিকটিম হিসাবে উপস্থাপন করে সুকৌশলে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে লিপ্ত হয়েছেন মাইকেল চাকমা। খাগড়াছড়ি এবং গুইমারার ঘটনায় তার মিথ্যা বয়ান এবং পাহাড়িদের বিষয়ে উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য এই বিষয়টিকে প্রমাণ করে। পাহাড়ের বাসিন্দারা বলছেন, যার হাতে নিজ জাতির প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক নেতার রক্ত লেগে আছে, তার কাছ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে মিথ্যাচার ও উস্কানিমূলক বক্তব্য ছাড়া কিছুই আশা করা যায় না।