Image description
বেগমপাড়ায় কাদের বাড়ি

এ বছরের জানুয়ারি মাসে কানাডা সরকার, বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধভাবে আসা অর্থের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করে। কানাডা যেন আর অর্থ পাচারকারীদের নিরাপদ গন্তব্য না হয় সেজন্য নেওয়া হয় একাধিক পদক্ষেপ। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলো, অভিবাসীদের অর্থের উৎস অনুসন্ধান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিহ্নিত অর্থ পাচারকারীরা তাদের লুণ্ঠিত অর্থ কানাডায় এনেছে কি না তা তদন্ত শুরু করে কানাডা সরকার। এ তদন্তে দেখা যায়, পানামা পেপারস এবং প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বেশির ভাগই কানাডায় সম্পদ কিনেছেন। এদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পানামা পেপারস এবং প্যারাডাইস পেপারসে যেসব বাংলাদেশি অর্থ পাচারকারীদের নাম প্রকাশ হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই কানাডায় সম্পদের মালিক হয়েছেন। করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে, সেই অর্থ বৈধভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কানাডায়। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যে সম্পদ করতেই এ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। বাংলাদেশের ১৪টি নাম ‘পানামা পেপারসে’ এবং ২৯ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছিল ‘প্যারাডাইস পেপারসে’। এসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীর নাম উঠে আসে।

পানামা পেপারসে আসা ১৪ নামের মধ্যে রয়েছে- বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেডের ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী, সেতু কর্পোরেশনের পরিচালক উম্মে রুবানা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, গুলশান-২ এর আজমত মঈন, বনানীর সালমা হক, এস এম জোবায়দুল হক, বারিধারার সৈয়দ সিরাজুল হক, ধানমন্ডির দিলীপ কুমার মোদি, শরীফ জহির, গুলশানের তারিক ইকরামুল হকসহ আরও অনেকে।

প্যারাডাইস পেপারসে যাদের নাম এসেছে তাদের মধ্যে রয়েছেন- যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মোগল ফরিদা ওয়াই ও শহিদ উল্লাহ, ঢাকার বনানীর চৌধুরী ফয়সাল, বারিধারার আহমাদ সামির, ব্রামার অ্যান্ড পার্টনার্স অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড ও ভেনাস ওভারসিজ কোং-এর মুসা বিন শমসের, ডাইনামিক এনার্জির ফজলে এলাহী, ইন্ট্রিপিড গ্রুপের কে এইচ আসাদুল ইসলাম, খালেদা শিপিং কোম্পানির জুলফিকার আহমেদ, নারায়ণগঞ্জের জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের তাজুল ইসলাম তাজুল, চট্টগ্রামের বেঙ্গল শিপিং লাইনসের মোহাম্মদ মালেক, ঢাকার সাউদার্ন আইস শিপিং কোম্পানির শাহনাজ হুদা রাজ্জাক, ওসান আইস শিপিং কোম্পানির ইমরান রহমান, শামস শিপিং লিমিটিডের মোহাম্মদ এ আউয়াল, ঢাকার উত্তরার এরিক জনসন আনড্রেস উইলসন, ইন্ট্রিডিপ গ্রুপের ফারহান ইয়াকুবুর রহমান, জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের তাজুল ইসলাম, পদ্মা টেক্সটাইলের আমানুল্লাহ চাগলা, রাশিয়ার নিউটেকনোলজি ইনভেস্টমেন্টের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান, মাল্টার মোহাম্মদ রেজাউল হক, নারায়ণগঞ্জের জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মোহাম্মদ কামাল ভূঁইয়া, তুহিন-সুমন, সেলকন শিপিং কোম্পানির মাহতাবা রহমান, নারায়ণগঞ্জের জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ফারুক পালওয়ান ও আয়ারল্যান্ডের গ্লোবাল এডুকেশন সিস্টেমের মাহমুদ হোসাইন। এ তালিকার সঙ্গে কানাডাসহ আরও কয়েকটি দেশে যারা সম্পদ কিনেছেন তাদের তালিকা মেলালে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, দেশের টাকা প্রথমে তারা এমন দেশে পাচার করেছেন যেখানে অর্থের উৎস জানতে চাওয়া হয় না। কর ফাঁকির অভয়ারণ্য দেশগুলোতে ভুয়া কোম্পানির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে হাজার কোটি টাকা। পরে এ টাকা বৈধ চ্যানেলে গেছে কানাডায়। যে কারণে ওই দেশের আইনে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা অর্থের সন্ধানে ২০২১ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই প্রতিবেদন কোনোদিন আলোর মুখ দেখেনি। সে প্রতিবেদনে অর্থ পাচারকারী ব্যক্তিদের মধ্যে উঠে আসে যুবলীগের সাবেক (বহিষ্কৃত) নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর এ কে এম মোমিনুল হক ওরফে সাঈদের নাম। এসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও দুবাইয়ে টাকা পাচার করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই পাচারকারীদের মধ্যে অন্তত তিনজন পাচারের টাকা কানাডায় বিনিয়োগ করেছেন।

বিদেশি ব্যাংক, বিশেষ করে সুইস ব্যাংকে পাচার করা ‘বিপুল পরিমাণ’ অর্থ উদ্ধারের যথাযথ পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়ে আওয়ামী লীগের শাসনামলে হাই কোর্টে রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল কাইয়ুম খান ও সুবীর নন্দী দাস। তার প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রুলসহ আদেশ দেন আদালত। সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি ব্যাংকে বাংলাদেশের কে কত টাকা পাচার করেছে, সে তথ্য জানতে চায় হাই কোর্ট।

এ ছাড়া পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারসে বাংলাদেশি যেসব নাগরিক ও কোম্পানির নাম এসেছে, তাদের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না এবং সে তদন্তের অগ্রগতি প্রতি মাসে আদালতকে জানাতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চান আদালত। কিন্তু সরকারের প্রভাবশালীদের নাম প্রকাশ হবে এ শঙ্কায় তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল নিজে আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নেন। ফলে, বেগমপাড়ার লুণ্ঠনকারীদের নাম আড়ালেই থেকে যায়।

হাই কোর্টে কানাডায় বেগমপাড়ার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার পর কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ পাচার বেড়ে যায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশি অর্থ পাচারকারীদের অন্যতম পছন্দের দেশ হয় কানাডা। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র অবৈধভাবে অর্থ পাচারের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিলে লুটেরারা কানাডামুখী হতে শুরু করে। এ সময় শুধু সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা নন, অতিরিক্ত সচিব এমনকি যুগ্ম সচিবরাও কানাডায় পিআর আবেদন করেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে অন্তত ৫৭০ জন সরকারি কর্মকর্তা কানাডায় অভিবাসনের জন্য আবেদন করেন। এদের মধ্যে প্রকৌশলী, চিকিৎসক এবং এনবিআরের কর্মকর্তাদের প্রাধান্য ছিল। এ সময়ে কানাডায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ডা. খলিলুর রহমানকে। তিনি আওয়ামী সমর্থক ব্যবসায়ী এবং আমলাদের অবৈধ অর্থ পাচারের প্রধান সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এ সময় আমলাদের মধ্যে যারা কানাডায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- সাবেক স্বাস্থ্য সচিব লোকমান হোসেন মিয়া, সাবেক সচিব আবদুল মালেক, সাবেক সচিব মেজবাহ উদ্দিন, সাবেক সচিব শাহ কামালসহ কয়েকজন।

এ সময় আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীরাও কানাডায় সম্পদ কিনতে শুরু করেন ব্যাপকভাবে। ব্যাংকিং খাতের অন্যতম প্রভাবশালী নজরুল ইসলাম মজুমদার, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ব্যবসায়ী নাফিজ সরাফতসহ কমপক্ষে ১৫ জন ব্যবসায়ী এ সময়ে কানাডায় বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কেনেন।

কয়েকজন রাজনীতিবিদও আলোচ্য সময়ে কানাডামুখী হন। শামীম ওসমানের আগে থেকেই কানাডায় বাড়ি ছিল। ২০০৭ সালে তিনি সেখানে বাড়ি কিনেছিলেন ২০২২ সালে তিনি কানাডায় আরেকটি বাড়ি কেনেন। সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়াসহ একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা এ সময় কানাডায় বাড়ির মালিক হন। তারা কেউই বৈধ পথে এসব সম্পদ কেনেননি।

ফজলে কবির ও রউফ তালুকদারের বক্তব্য : বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৬ অক্টোবর ‘আলোচিত যাদের ঠিকানা এখন কানাডা’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের একাংশের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফজলে কবির এবং আবদুর রউফ তালুকদার। তাদের দাবি, কানাডাতে তাদের কোনো বাড়ি ও ফ্ল্যাট নেই। প্রতিবেদনে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা সঠিক নয়।