
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ম্যান্ডেট নিতে গণভোট করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের। কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার। এরই মধ্যে বেশির ভাগ দল সরকারের এ বার্তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। বিশেষ করে আলোচনায় থাকা বড় তিনটি দল বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষ থেকে এ নিয়ে সরকারকে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে। সেসব বৈঠকে নির্বাচনের দিন গণভোট করার বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে।
তিনটি দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির দাবি ছিল জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি দিতে। তবে বিএনপি জুলাই জাতীয় সনদের স্বাক্ষরকে বাস্তবায়নের একমাত্র ম্যান্ডেট বলে জানিয়ে আসছিল। এ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার টেবিলে যখন পরিস্থিতি দিনের পর দিন জটিল হয়ে উঠছিল তখনই সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের আয়োজনের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। জামায়াত ও এনসিপির দাবির সঙ্গে বিষয়টি মিলে যাওয়ায় তাদের পক্ষ থেকে পর্দার আড়ালে তেমন কোনো বিরোধিতা করা হয়নি। বিএনপির পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে কিছুটা দ্বিমত জানানো হয়। পরে প্রধান উপদেষ্টার বার্তা নিয়ে চলতি সপ্তাহের প্রথমদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের বাসায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা বৈঠক করেন। সেখানে আরও কয়েকটি দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। দীর্ঘক্ষণ অনুষ্ঠিত হওয়া ওই অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে শেষ পর্যন্ত বরফ গলে। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত মেনে নেয় ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো।
পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়া বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়। শেষে তারা গণভোটের পক্ষে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তবে জামায়াতের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের তফসিলের আগে গণভোটের আয়োজন করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও এটাকে ‘পার্ট অব পলিটিক্স’ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বয়োজ্যেষ্ঠ এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ম্যান্ডেট নিতে জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ দল এ নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। কয়েকটি দল এর বিরোধিতা করছে। তাদের সঙ্গে সরকারের ওই বার্তা নিয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করছি। আশা করি, তারাও সরকারের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখবে। যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, আইনি ভিত্তি ছাড়া আসলে জুলাই জাতীয় সনদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আইনি ভিত্তি দেওয়া না হলে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ রবিবার গণমাধ্যমকে বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের সম্মতির জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে। এটি জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম পদক্ষেপ বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে যে আইনসভা গঠিত হবে এবং সে আইনসভা জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে যেসব সংস্কার করবে তা যেন টেকসই হয়, সে ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যত ঐকমত্য রয়েছে বলে জানান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
একই প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের রায় নিতে সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিনে আলাদা ব্যালটে গণভোটের কথা বলেছি। ওই ভোটে যদি জনগণ রায় দেয়, তাহলে সেটা বাস্তবায়ন করতে পরবর্তী সংসদ বাধ্য থাকবে। এই রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের সংবিধানে কোনো সংশোধনী আগে আনতে হবে না। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি রচনার জন্য গণভোট হলে এটা হবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। এটা কখনো চ্যালেঞ্জ করতে গেলে টিকবে না। পার্লামেন্টে এটাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না। এ বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো দূরত্ব নেই। গণভোটের রেজাল্ট যদি আমাদের বিপক্ষেও যায়, আমরা এখানে ছাড় দেব। তিনি বলেন, সংস্কারের বিষয়ে আমরা সব সময় সোচ্চার ছিলাম। সনদ বাস্তবায়ন আইনি ভিত্তির জন্য গণভোটের পক্ষে সবাই মত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে গণভোট আগে না পরে এটা আলোচনার সুযোগ আছে। সবাই গণভোটের পক্ষে একমত হয়েছে। গণভোট আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। তার জন্য সরকারের নির্বাচন কমিশনকে একটা নির্দেশনা দিতে হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটের পাশাপাশি গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট থাকবে। যেখানে সনদ বাস্তবায়নে জনগণ হ্যাঁ বা না ভোট দেবে। নোট অব ডিসেন্টে যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, সেগুলোকে একমত বলে ধরে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের বিষয়টিও অনুসরণ করা যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে জনগণ জুলাই বাস্তবায়ন করার পক্ষে রায় দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।