
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় নিয়মিত চেকপোস্টে গতকাল রোববার সকালে গাড়ি চেক করছিল পুলিশ। এ সময় বালুবোঝাই একটি ট্রাক আটক করা হলে চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালান ট্রাকশ্রমিকেরা। এতে পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন।
চাঁদাবাজদের হাতেনাতে ধরতে গত শনিবার অভিযানে নেমেছিলেন নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন। এ সময় চাঁদাবাজদের হামলায় তাঁর বুকের একটি হাড় ভেঙে যায়। বর্তমানে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন এই কর্মকর্তা। একই দিনে বগুড়ার শিবগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে হাতকড়াসহ ১২ মামলার আসামি এক আওয়ামী লীগ নেতাকে ছিনিয়ে নেয় গ্রামবাসী।
সিলেট, নরসিংদী ও বগুড়ার এই তিন ঘটনা পুলিশের অভিযানে বাধা দেওয়ার তাজা উদাহরণ। এভাবে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশের আটটি বিভাগেই পুলিশের ওপর হামলা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। এই আট মাসে সারা দেশে ৪১৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৬৪টি মামলা হয়েছে। এরপর চট্টগ্রামে ৯২টি, সিলেটে ৪৩টি, রাজশাহীতে ৩৫টি, খুলনা ও বরিশালে ৩০ ও ২৬টি, ময়মনসিংহে ১৩টি এবং রংপুরে সবচেয়ে কম ১২টি হামলার ঘটনা ঘটে।
পুলিশের ওপর হামলার প্রবণতা শুরু হয় গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের সময় থেকেই। ওই সময় হামলায় সারা দেশে পুলিশের ৪৬০টি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ১২০টি থানা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিহত হন ৪৬ জন পুলিশ সদস্য। এই হামলার ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি পুলিশ। ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে তাদের মনোবল। তার মধ্যেই এখনো হামলা চলছে।
এমন চলতে থাকলে নির্বাচনের আগে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশকে নিয়ে যে রকম উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল, তা নেওয়া হয়নি। আমাদের রাজনীতিক ও জনগণ বুঝতে চায় না, পুলিশ ছাড়া দেশ চলতে পারবে না। পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকলে জননিরাপত্তা চরম ঝুঁকিতে পড়বে। রাষ্ট্র পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না, কোনো হুঁশিয়ারি কেউ দিচ্ছে না। যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, তার পুরো সুযোগটি অপরাধীরা নিচ্ছে, তাই পুলিশ হামলার শিকার হচ্ছে। নির্বাচনের আগে পুলিশকে ঠিকভাবে দাঁড় করাতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচনে ঝুঁকি আছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে হামলার শিকার হয় ওই থানার পুলিশ। হামলায় তিন উপপরিদর্শকসহ (এসআই) চার পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। গুরুতর আহত কনস্টেবল আল-আমিন এখনো চিকিৎসাধীন।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় দৈনিক গড়ে আটটি মামলা হয়। অর্থাৎ আটটি হামলার ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সারা দেশে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ছিল ৩১টি, তবে গত আগস্টে তা বেড়ে ৫১টি হয়েছে। অর্থাৎ একটি মাসের হামলার চিত্র তুলনা করলে দেখা যায় তা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। প্রতি মাসেই এভাবে হামলা বাড়ছে।
গত ১১ মার্চ রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ে আব্দুর রাজ্জাক ফাহিম নামের এক যুবকের অতর্কিত হামলায় রাজধানীর পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলামসহ পুলিশের তিনজন কর্মকর্তা আহত হন। এ ছাড়া সম্প্রতি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, যশোর, সাতক্ষীরা, মৌলভীবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও হামলা চালিয়ে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে।
এসব হামলার সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ আসছে। এর মধ্যে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। সারা দেশে ৪৪টি হামলায় ৩৯ জন আসামিকে ছিনিয়ে নিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা।
পুলিশ বিভিন্ন মাজারের হামলা ঠেকাতে গিয়েও হামলার শিকার হয়েছে, গাজীপুর, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহে পুলিশ এসব ঘটনায় একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তৌহিদি জনতার ব্যানারে উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিরা পুলিশের ওপর হামলার চালিয়েছে।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৫ আগস্টের পর মাঠপর্যায়ে অপারেশনের ধরন পরিবর্তন করেছে পুলিশ। বর্তমানে ‘আক্রমণাত্মক’ পুলিশিংয়ের পরিবর্তে আত্মসমর্পণমূলক পুলিশিং করছে, তারপরও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলার শিকার হচ্ছে।
পুলিশের ওপর ক্রমাগত হামলা ও আক্রমণের বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। তিনি বলেন, পুলিশের ওপর এ রকম হামলা ঠেকাতে সবার কথা বলতে হবে। কিন্তু সবাই চুপ করে আছে। সবাই আইজিপিকে প্রশ্ন করছেন, কিন্তু হামলার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলছেন না, প্রতিবাদ করছে না। পুলিশ যদি কাজ না করতে পারে, তাহলে কেউ নিরাপদ থাকবেন না।
পুলিশের এই দুরবস্থার শুরুটা পূর্বের সরকার সৃষ্টি করে গেছেন বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকাকালীন, দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল পুলিশ। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবেও সমালোচিত হয়েছে পুলিশ ও র্যাবের প্রধানসহ অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাদের ওপরে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সহিংসতা, বিরোধীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা এবং বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যাকাণ্ডে জড়ানোর দায়ে অনেক পুলিশ সদস্য এখন কারাগারে; অনেকে আবার পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এসে পুলিশকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগের কথা বললেও তা এগোয়নি। এমনকি পুলিশ সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হলেও ওই কমিশনের দেওয়া প্রতিবেদন ঐকমত্য কমিশনে এক দিনের বেশি আলোচনা হয়নি। পুলিশের স্বাধীন কমিশন গঠনের আলোচনাও থমকে গেছে।
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, পুলিশ স্বাধীনভাবে কাজ করুক, পেশাদারি বজায় থাকুক, এটা কখনো কেউ চায়নি। তাই পুলিশের আজ এই অবস্থা। পুলিশ একসময় মারছে, এখন পুলিশ মার খাচ্ছে।