
উৎপাদন বাড়াতে দেশজুড়ে চলছে ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা। ৪ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই নিষেধাজ্ঞা চলবে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। টানা ২২ দিন নদী সাগরে জাল ফেলতে পারবে না জেলেরা। ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম হিসাব করে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত কতটুকু বাঁচবে মা ইলিশ তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জেলেরা। এখনো ডিম আসেনি ইলিশের পেটে দাবি করে তারা বলছেন, এই ২২ দিনে ডিম এলেও তা পরিপক্ব হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর যখন জেলেরা নামবে পানিতে তখন গণহারে মারা পড়বে মা ইলিশ। সেই সাথে ব্যর্থ হবে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মা ইলিশ বাঁচানোর উদ্যোগ। জেলেদের এই দাবি মানতে নারাজ মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা ও ইলিশ বিশেষজ্ঞরা। পেটে ডিম এসে পরিপক্ব হওয়ার জন্য আলোচ্য ২২ দিনই যথেষ্ট উল্লেখ করে তারা বলছেন, বহু বছরের গবেষণালব্ধ ফল অনুযায়ী প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করেছে সরকার। জেলেরা যা বলছে তা কেবলই তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। সরকার যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেটাই সঠিক।
দেশে উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৬৪ ভাগের জোগান দেয় বরিশালের ইলিশ মোকাম। নগরীর পোর্ট রোডে কীর্তনখোলার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই মোকামের ব্যবসায়ী গোপাল সাহা বলেন, ‘৩ অক্টোবর মধ্যরাত পর্যন্ত নদী সাগরে ইলিশ ধরেছে জেলেরা। মোকামে আসা ওইসব ইলিশের শতকরা ৯৮ ভাগের পেটে ছিল না ডিম। এটা নিয়ে আমরা বারবার বলেছি মৎস্য বিভাগকে। প্রজনন মৌসুম নির্ধারণে ভুল হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে বলেছি তাদের। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেনি।’ বরগুনা জেলা মৎস্য ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘পেটে ডিম আসা থেকে শুরু করে তা পরিপক্ব হওয়া ও ডিম ছাড়তে কম করে হলেও এক-দেড় মাস সময় লাগে ইলিশের। ৪ তারিখ থেকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার সাথে হিসাব মেলালে ইলিশের সত্যিকারের প্রজনন মৌসুম শুরু হতে অক্টোবরের ৮-১০ তারিখ লেগে যাবে। যা পরিপক্ব হয়ে ডিম ছাড়া শেষ হবে নভেম্বরের প্রথম দিকে। সেক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার সময়টিতে থাকবে ইলিশের ভরা প্রজনন মৌসুম। এ অবস্থায় জেলেরা যখন জাল নিয়ে নামবে নদী সাগরে তখন বেপরোয়াভাবে মারা পড়বে মা ইলিশ। গত ৭-৮ বছর ধরে এমন পরিস্থিতি দেখছি আমরা।’
কুয়াকাটা মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম খান বলেন, ‘ধরা পড়া ইলিশের অবস্থা দেখে আমরা সরকারকে বলেছিলাম এবারকার প্রজনন মৌসুমের হিসাব অন্তত সপ্তাহখানেক পিছিয়ে দিতে। ৩৫-৪০ বছর ধরে ইলিশ নিয়ে কারবার করছি। গবেষকরা যেভাবেই গবেষণা করুন আমাদের অভিজ্ঞতারও তো কিছু দাম আছে। পরিস্থিতি যা দেখছি তাতে এবার প্রজনন মৌসুমে ইলিশ রক্ষার যে উদ্যোগ তা মাঠে মারা যাবে।’ বরিশাল ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী জহির সিকদার বলেন,
‘অমাবস্যা পূর্ণিমার হিসাব কষে ইলিশের প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করে মৎস্য বিভাগ। এটাই চলে আসছে বহু বছর ধরে। এই হিসাব কষে দেওয়া হয় মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু আরো কিছু বিষয়ে এখন নজর দেওয়া উচিত। বিশ্বজুড়ে চলছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এই পরিবর্তনের কারণে স্বাভাবিক অনেক কিছুই আর আগের মতো নেই। আগে সাগরে মাছ ধরায় যে ৬০ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতো তার সময়কালেও পরিবর্তন ঘটেছে। সে অনুযায়ী গত বছর নতুন নিয়মে জারি হয় নিষেধাজ্ঞা। এসব বিষয় মাথায় রেখে ইলিশের প্রজনন মৌসুম প্রশ্নে নতুন করে গবেষণা হওয়া উচিত।’ মোকামের আরেক ব্যবসায়ী ইয়ার হোসেন বলেন, ‘৩ অক্টোবর পর্যন্ত যত ইলিশ ধরা পড়েছে তার প্রায় কোনোটির পেটেই ডিম পাইনি। এখন এই ২২ দিনের মধ্যে কী ডিম উড়ে চলে আসবে? গত কয়েক বছর ধরেই এটা দেখছি। প্রজনন মৌসুম নির্ধারণে ভুলের কারণেই হয় এটা।’
জেলে আর ব্যবসায়ীদের এসব বক্তব্য মানতে নারাজ ইলিশ বিশেষজ্ঞরা। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিশিষ্ট ইলিশ গবেষক ড. মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ সহজ বিষয় নয়। বহু গবেষণার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমায় ডিম ছাড়তে সাগর থেকে মিঠা পানির নদ-নদীতে আসে ইলিশ। এ সময় ঘণ্টায় ৭৫-৮০ কিলোমিটার বেগে উজান ঠেলে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে তারা। মোহনায় জাল কিংবা অন্য কোনো কিছুতে বাধা পেলে না ঢুকে ফিরে যায় সাগরে। এজন্য আশ্বিনের পূর্ণিমার তিনদিন আগে থেকে নির্ধারণ করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা শুরুর সময়। এক সময় এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ছিল কেবলই পূণিমা। আগে-পরের ৬ দিন যোগ করায় বেড়েছে ইলিশের ডিম ছাড়ার পরিমাণ।
গত বছরও শতকরা ৫২ দশমিক ৪ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে। এবার নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগে ২০ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর উপকূলীয় এলাকা ঘুরে দেখেছি। ইলিশের শুক্রাণু ছাড়ার নমুনা পেয়েছি তখন। নারী ইলিশের পেটেও আসতে শুরু করেছে ডিম। এই ডিম পরিপক্ব হয়ে ছাড়ার জন্য ১৫ দিন যথেষ্ট। আমাদের গবেষণা কিংবা প্রজনন মৌসুম নির্ধারণে কোনো ভুল নেই।’ জেলেদের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওরা জানে যে পূর্ণিমার সময় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ঢোকে নদীতে। নিষেধাজ্ঞার তারিখ যদি পাঁচ দিনও পেছায় তাহলে ধরা যাবে বিপুল পরিমাণ ইলিশ। আর্থিকভাবে লাভবান হবে তারা। এজন্যই এই দাবি। তাছাড়া সব ইলিশের পেটে ডিম থাকবে এমন কথা নেই। পুরুষ ইলিশও তো রয়েছে। একচুল এদিক ওদিক হলে ইলিশ সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি হবে।’
বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘জেলেদের এসব বক্তব্যের প্রতিফলন গত কয়েক বছর ধরেই দেখছি। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর খবরের কাগজে বড় বড় শিরোনামে ছাপা হয় মা ইলিশ নিধনের খবর। উৎপাদন প্রশ্নে ধারাবাহিক যে বৃদ্ধি তাও কিন্তু কমেছে। জুলাই-আগস্ট মাসে বরিশাল বিভাগে ইলিশ আহরণের পরিমাণ কমেছে আগের বছরের তুলনায় শতকরা ২৭ ভাগ। এসব হিসাবের সঙ্গে যদি জেলেদের দাবি মেলাই তাহলে কিন্তু অনেক কিছু মিলে যায়। তার পরও বলব, জেলেরা যখন বলছে তখন সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর উচিত নতুনভাবে যাচাই করা।’