Image description
বিশ্ব বসতি দিবস আজ

দেশে নিম্ন-আয়ের দুস্থ মানুষ আবাসন সংকটে দিশেহারা। অনেকেই স্থায়ী আশ্রয়ের অভাবে রোদে পুড়ছে, বৃষ্টিতে ভিজছে। ফুটপাত বা ওভারব্রিজের নিচে পলিথিনের ঘরে দিন-রাত পার করছে। শহরে নিম্ন-আয়ের মানুষের আবাসনের জন্য নেওয়া প্রকল্পগুলো ধনীদের কবজায় চলে গেছে। ফলে শহরের বস্তি এলাকায় বসতি বাড়ছে। বিভিন্ন বস্তিতে বসবাস করছে ১৮ লাখ ৪৮৬ মানুষ। গ্রামে দরিদ্রদের জন্য নেওয়া প্রকল্পগুলো অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় তা সুফল বয়ে আনেনি। গুচ্ছগ্রাম, আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এখনো শহর ও গ্রাম মিলে ৬০ লাখ দুস্থ পরিবার বাসস্থান ঘাটতিতে ভুগছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে ঘাটতি দাঁড়াবে ১ কোটি ৫ লাখ। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দিনদিন দেশে উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ছে। এ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার পরও সরকারের পক্ষ থেকে নিম্ন-আয়ের মানুষের আবাসন নিশ্চিতে জাতীয় পর্যায় থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন, বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

দেশের নিম্ন-আয়ের মানুষের আবাসনের এমন অবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও জাতীয়ভাবে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব বসতি দিবস। এবার প্রতিপাদ্য-‘পরিকল্পিত উন্নয়নের ধারা, নগর সমস্যায় সাড়া’। ১৯৮৬ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ ধরনের দিবসসহ বিভিন্ন সময় দেশের সরকারগুলো সবার জন্য আবাসন স্লোগান দিলেও কার্যত এর কোনো বাস্তবায়ন নেই। নাগরিকদের আবাসনের চাহিদা পূরণ হচ্ছে ব্যক্তিগত ও বেসরকারি উদ্যোগে। উচ্চ ও মধ্যবিত্তরা নিজেদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারলেও নিম্ন-আয়ের মানুষ আছেন চরম বিপাকে। গ্রামের দুস্থ মানুষ কোনোরকম মাধা গোঁজার ঠাঁই পেলেও শহরে বসবাসকারীদের জীবন কঠিন হয়ে পড়ছে। তারা জীবনযাপনের খরচের হিসাব মেলাতে পারছেন না। ফলে কেউ বস্তির জীবন বেছে নিচ্ছেন, কেউবা হয়ে পড়ছেন ভাসমান।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ভাসমান মানুষের সংখ্যা ২২ হাজার ১১৯ জন। এ তালিকায় আছে, যাদের বসবাসের ঘর-বাড়ি নেই। যারা রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, মাজার, ফুটপাত, সিঁড়ি, ওভারব্রিজের নিচে, লঞ্চটার্মিনাল, ফেরিঘাট, মার্কেটের বারান্দায় দিনাতিপাত করেন। আর বস্তিতে বসবাস করছেন ১৮ লাখ ৪৮৬ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের নগর অঞ্চলের জনসংখ্যা ৪০.৪৭ শতাংশ অর্থাৎ ৭ কোটি, ২০৫০ সালে এটি বেড়ে দাঁড়াবে ৫৬ শতাংশে। বর্তমানে দেশে মোট ৬০ লাখ দুস্থ পরিবারে আবাসন ঘাটতি আছে। ২০৩০ সালে আবাসন ঘাটতি বেঁড়ে দাঁড়াবে ১ কোটি ৫ লাখ ইউনিট। ২০৫০ সালে এটি বেঁড়ে দাঁড়াতে পারে ১ কোটি ৩৩ লাখে।

বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপের তথ্য এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১৯৬০ সালে দেশের নগরায়ণের হার ছিল ৫.১৪ শতাংশ, ১৯৭৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮.৭৫ শতাংশে; ২০১১ সালে ২৩.৩০ এবং ২০২৩ সালে ৪০.৭৪ শতাংশ। দেশের নগরায়ণ মূলত অপরিকল্পিত এবং ঢাকাকেন্দ্রিক। এর উদাহরণ বর্তমান দেশের নগরাঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ রাজধানী ঢাকায় বসবাস করে। এখনো প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার মানুষ নতুন করে ঢাকায় ঢুকছে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই শহরে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যা আবাসনসহ বহুমুখী সংকট বাড়াচ্ছে।

এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে আবাসনের বিষয়টি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারি অর্থায়ন বা ঋণ সুবিধাও বেশ জটিল। তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে আবাসনের বিষয়টি সরকারের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায়। সব মানুষের আবাসন নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারের দায় থাকে। বাংলাদেশ সরকার সব মানুষের আবাসন নিশ্চিত করার কথা বললেও বৃহত্তর আবাসন নীতিমালায় শুধু দুস্থ, বিধবাসহ কয়েক শ্রেণির মানুষের কথা বলা হয়েছে। সুন্দরভাবে বসবাস নিশ্চিত করতে সব মানুষের আবাসন নিয়ে ভাবতে হবে।

নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, দেশের আবাসন নীতি অংশগ্রহণমূলক নয়। এ কারণে দেশের নিম্ন-আয়ের মানুষের আবাসনের সমাধান মিলছে না, দিনদিন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। শহরের নিম্ন-আয়ের মানুষের আবাসন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। শহরাঞ্চলের নিম্ন-আয়ের মানুষ দিনদিন বস্তিবাসী বা ভাসমান হয়ে পড়ছে। আর গ্রামের নিম্ন-আয়ের মানুষ কোনোরকম মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে পারছেন। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে শহর এলাকায় নিম্ন-আয়ের মানুষের কথা বলে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, এগুলোর কোনোটি নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য হয়নি। বিপরীতে ধনীদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ধনীদের জন্য নেওয়া প্রকল্পে একজনকে একটি ফ্ল্যাট দিয়েই আবাসন সমস্যার সমাধান করা যেত, সেখানে তাকে প্লট দেওয়া হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে অনেককে একাধিক প্লটও দেওয়া হয়েছে। আর গ্রামে দরিদ্রদের জন্য নেওয়া প্রকল্পগুলো অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় সেগুলো বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সারা দেশে ৩০টি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, নোয়াখালী, যশোর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, মাদরীপুর, গোপালগঞ্জ, মগুরা, শরীয়তপুর, নড়াইল, খুলনা, মৌলভীবাজার, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এসব প্রকল্পে ৬ হাজার ৪৩২টি পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ২৭টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১৪টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পে ৫ হাজার ৯৩০টি পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাছাড়া শেরপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, হবিগঞ্জ, সিলেট, ঝিনাইদাহ, ঝালকাঠি, মাদারীপুর, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে ১৩টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১ হাজার ৯৩৫টি পরিবারে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

রাজউক সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় রাজউক পূর্বাচল, ঝিলমিল এবং উত্তরা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় আবাসন প্রকল্পে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ফ্ল্যাটগুলো উচ্চমূল্যের কারণে নিম্ন-আয়ের লোকদেরও নাগালের বাইরে। পূর্বাচল, ঝিলমিল ও উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প গ্রহণ করছে সরকার। এর বাইরে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। উচ্চমূল্য থাকায় দেশের বেশির ভাগ মানুষের এসব প্রকল্পের ফ্ল্যাট কেনার মতো সামর্থ্য নেই। প্রকল্পগুলোর সুবিধা পাচ্ছে শহরে বসবাসরত সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সম্পদশালী ব্যক্তিরা। যাদের অনেক ফ্ল্যাট আছে, তারা আরও ফ্ল্যাট কিনছেন। কিন্তু বাস্তহারা, দরিদ্র, নিম্নবিত্তরা সরকারি এসব আবাসন সুবিধার নাগাল পাচ্ছেন না। অল্প দামে জমি অধিগ্রহণ করে সরকার আবাসন প্রকল্প তৈরি করে যাদের নামে বরাদ্দ দিচ্ছেন, তারা রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে জমির মালিকরা নায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।

গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিশ্ব বসতি দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে সরকার আজ দেশজুড়ে র‌্যালি, আলোচনা সভা, সেমিনারসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম নগরায়িত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে নাগরিক জীবনমানে নগরায়ণের কাঙ্ক্ষিত সুফল দেখা যাচ্ছে না। একদিনে রাজধানীকেন্দ্রিক অপরিকল্পিত ও ভারসাম্যহীন নগরায়ণ হচ্ছে; অন্যদিকে দেশের অন্যান্য নগর এলাকার যথাযথ বিকাশ ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব সংকট মোকাবিলায় দ্রুত, স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমন্বিত উদ্যোগ এবং বাস্তবায়ন জরুরি। এই বছরের বিশ্ব বসতি দিবসের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট।