
বাংলাদেশের বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-মাদ্রাসা ও প্রাথমিক-ইবতেদায়ির শিক্ষকরা এখন কঠিন বাস্তবতায় জীবন পার করছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন বেতনে জীবনযাপন করা এই মানুষগুলো মর্যাদাহীনতা, আর্থিক অনিশ্চয়তা ও প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলার বোঝা বইছেন বছরের পর বছর।
কেউ মাসে পান মাত্র ১১ হাজার টাকা বেতন, বাড়িভাড়ার ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা। চিকিৎসা ভাতা তো নামমাত্র। অনেকে সংসার চালাতে ঋণের জালে জড়িয়েছেন, আবার কেউ অবসরের চার বছর পার করেও পেনশনের টাকা না পেয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। এমন অবস্থায় তরুণ প্রজন্ম ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে শিক্ষকতা পেশা থেকে।
পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে এখন প্রায় তিন লাখ ৮০ হাজার প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক রয়েছেন। শিশুশিক্ষার ভিত্তি তৈরির দায়িত্ব তাদের হাতে, অথচ তারা নিজেরাই রয়েছেন নানা আর্থিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক মর্যাদার সংকটে। গত এক দশকে তারা বারবার দাবি তুলেছেন—বেতন কাঠামো উন্নতকরণ, মর্যাদা পুনর্নির্ধারণ, পদোন্নতি ও পেনশন সংস্কারে। কিন্তু দাবি বাস্তবায়নের পথটি যেন এখনও দীর্ঘ ও অনিশ্চিত!
শিক্ষকদের অভিযোগ, তাদের দীর্ঘ আন্দোলন, মানববন্ধন, অনশন, এমনকি ক্লাস বর্জনের মতো কর্মসূচিও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। অনেকে বলেন, শিক্ষা নিয়ে বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও শিক্ষকদের জীবনে পরিবর্তন আসছে না।
বিশ্বের প্রায় সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষকতা পেশাটি সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন। সেখানে শিক্ষকরা শুধু সম্মানেই নন, আর্থিক দিক থেকেও রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষিত। উচ্চ বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা বা অবসরকালীন সুবিধা— সব ক্ষেত্রেই তারা পান বিশেষ অগ্রাধিকার। দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ও মর্যাদা এখনও সেই মানে উন্নীত হয়নি
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন মাসুদ
বেতন কাঠামো: জীবনধারণের জন্য অপ্রতুল
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষকরা এখনও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে গণ্য হন। তাদের বেতন কাঠামো ১৩তম গ্রেডে সীমাবদ্ধ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের মূল বেতন ১১ হাজার টাকা। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা যোগ করে সর্বসাকুল্যে তাদের মাসিক আয় দাঁড়ায় মাত্র সাড়ে ১৯ হাজার টাকার মতো। এই আয়ে পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা মেটানোই কঠিন। ফলে প্রায় সব শিক্ষকই কোনো না কোনোভাবে ঋণের বোঝায় জর্জরিত।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম। তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের গড় মাসিক বেতন মাত্র ১৭০ দশমিক ২ ডলার— যা বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় মাসিক আয়ের তুলনায় প্রায় ৬২ ডলার কম।
অন্যদিকে, একই অঞ্চলের দেশগুলোর প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। মালদ্বীপে একজন প্রাথমিক শিক্ষকের মাসিক গড় বেতন প্রায় ৯৫৩ দশমিক ১৩ ডলার, যা বাংলাদেশের শিক্ষকদের আয়ের প্রায় পাঁচ গুণ। পাকিস্তানে শিক্ষকদের গড় বেতন ২০৬ দশমিক ৭ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ২৫০ দশমিক ৪৪ ডলার, আর ভারতে রাজ্য ও বিষয়ভেদে পার্থক্য থাকলেও গড় বেতন প্রায় ২৮৪ দশমিক ৬৪ ডলার।
যার পেটে ভাত নেই, তার কাছ থেকে জ্ঞান আশা করা যায় না। আমরা শিক্ষকদের এমন অবস্থায় রেখেছি, যেখানে তারা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতেও পারেন না। এতে শিক্ষার মান নষ্ট হচ্ছে
ড. এ. বি. এম. ওবায়দুল ইসলাম, উপাচার্য, বাউবি
এছাড়া ভুটানে প্রাথমিক শিক্ষকদের মাসিক গড় আয় ৩৪১ দশমিক ৭২ ডলার, নেপালে ৪৬৭ দশমিক ৪৫ ডলার এবং প্রতিবেশী মিয়ানমারে ১৮৯ দশমিক ২২ ডলার।
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন মাসুদ আক্ষেপ করে বলেন, ‘বিশ্বের প্রায় সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষকতা পেশাটি সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন। সেখানে শিক্ষকরা শুধু সম্মানেই নন, আর্থিক দিক থেকেও রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষিত। উচ্চ বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা বা অবসরকালীন সুবিধা— সব ক্ষেত্রেই তারা পান বিশেষ অগ্রাধিকার। দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ও মর্যাদা এখনও সেই মানে উন্নীত হয়নি। এ কারণে আজও শিক্ষকরা সমাজে তাদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
দেশের হাজারও এমপিওভুক্ত শিক্ষক অত্যন্ত স্বল্প বেতনে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরা গড়ে ১৬ হাজার টাকার আশেপাশে বেতন পান। অনেক শিক্ষক ১২ হাজার ৫০০ টাকা কিংবা মাদ্রাসা পর্যায়ে মাত্র ৯ হাজার ৩০০ টাকা বেতন পান। এই সামান্য আয়ে শিক্ষকদের পক্ষে পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, বাজারদরের ঊর্ধ্বগতির কারণে মাসের মাঝামাঝি আসতেই অনেক শিক্ষক আর্থিক টানাপোড়েনে পড়েন
অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী, সদস্য সচিব, এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট
মাধ্যমিক শিক্ষকতায়ও চরম অসঙ্গতি
অন্যদিকে, মাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা চাকরির শুরুতে হাতে পান মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নামমাত্র বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা। শিক্ষকদের ভাষায়, এই বেতনে সংসার চালানো মানেই প্রতি মাসে ঋণগ্রস্ত হয়ে টিকে থাকা।
জাতীয়করণের দাবিতে বহুদিন ধরে আন্দোলন করছেন তারা। সরকারি কিছু সুবিধা যুক্ত হলেও বাড়িভাড়া হিসেবে মাসে মাত্র ৫০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা রাজধানীসহ দেশের যেকোনো অঞ্চলের বাস্তবতার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। বর্তমানে একটি বেসরকারি চেম্বারে চিকিৎসক দেখানোর ফি যেখানে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা, সেখানে শিক্ষকের চিকিৎসা ভাতা থাকে কেবল নামমাত্র।
এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী অভিযোগ করেন, ‘দেশের হাজারও এমপিওভুক্ত শিক্ষক অত্যন্ত স্বল্প বেতনে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরা গড়ে ১৬ হাজার টাকার আশেপাশে বেতন পান। অনেক শিক্ষক ১২ হাজার ৫০০ টাকা কিংবা মাদ্রাসা পর্যায়ে মাত্র ৯ হাজার ৩০০ টাকা বেতন পান। এই সামান্য আয়ে শিক্ষকদের পক্ষে পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, বাজারদরের ঊর্ধ্বগতির কারণে মাসের মাঝামাঝি আসতেই অনেক শিক্ষক আর্থিক টানাপোড়েনে পড়েন।’
এই শিক্ষক নেতা অভিযোগ করে আরও বলেন, ‘চাকরি শেষে পেনশন পাওয়ার জন্যও বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। কেউ কেউ অবসরের পর ৪-৫ বছর ধরে ঘুরছেন পেনশনের টাকা তোলার জন্য।’
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম। দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের গড় মাসিক বেতন মাত্র ১৭০ দশমিক ২ ডলার। মালদ্বীপে গড় বেতন ৯৫৩ দশমিক ১৩ ডলার, পাকিস্তানে ২০৬ দশমিক ৭ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ২৫০ দশমিক ৪৪ ডলার, আর ভারতে রাজ্য ও বিষয়ভেদে পার্থক্য থাকলেও গড় বেতন প্রায় ২৮৪ দশমিক ৬৪ ডলার
বিশ্লেষকদের পরামর্শ: মর্যাদা ও বাজেট বৃদ্ধি জরুরি
এমন অবস্থায় শিক্ষা-বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষকদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে না পারলে সমাজে মানসম্মত শিক্ষা টেকসই হয় না। শিক্ষকদের দারিদ্র্য ও হতাশা শিক্ষার্থীদের শেখার আনন্দকে নিঃশেষ করে দেয়। একই সঙ্গে বেতন-মর্যাদার ঘাটতি শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা কমিয়ে দিচ্ছে, ফলে পাঠদানের মানেও প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপাচার্য ড. এ. বি. এম. ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশের শিক্ষকরা যে বেতন পান, তা একেবারেই অপ্রতুল। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো অর্থাৎ ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান— সবখানেই শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল ও মর্যাদা নির্ধারিত। অথচ আমরা শিক্ষায় জিডিপির মাত্র ২ শতাংশেরও কম ব্যয় করি। জাতিসংঘের সুপারিশ অনুযায়ী এই খাতে অন্তত ৬ শতাংশ ব্যয় করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘যার পেটে ভাত নেই, তার কাছ থেকে জ্ঞান আশা করা যায় না। আমরা শিক্ষকদের এমন অবস্থায় রেখেছি, যেখানে তারা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতেও পারেন না। এতে শিক্ষার মান নষ্ট হচ্ছে।’
শিক্ষাবিদ ও ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই. কে. সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেন, ‘শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন ও সমতা নিশ্চিতের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা। এতে শিক্ষকদের জীবনের নিরাপত্তা, কর্মস্থলের স্থিতিশীলতা এবং শিক্ষার মান— সবই উন্নত হবে।’