Image description
পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা আলবেনিয়ায় বন্দি

বনানী থানার বরখাস্ত পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানা। আওয়ামী লীগ শাসনামলে ঘুস বাণিজ্যের পাশাপাশি দেশে পারিবারিক সিন্ডিকেটে ই-অরেঞ্জ নামে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান খুলে হাতিয়েছেন ১১শ কোটি টাকা। এরপর পালিয়ে ভারতে গ্রেফতার হলে সেখানকার আদালতে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে জামিনে বের হন। এরপর থেকে তিনি লাপাত্তা হয়ে যান। প্রায় চার বছর চলে তার ফেরারি জীবন। গত ফেব্রুয়ারিতে পর্তুগাল হয়ে আলবেনিয়ায় পালানোর সময় গ্রেফতার হন সোহেল রানা। এখন তিনি আলবেনিয়ার কারাগারে বন্দি। তবে এখনো প্রতারণার মাধ্যমে নিজেকে রক্ষার ফন্দি আঁটছেন। এক্ষেত্রে জুলাই আন্দোলনকে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। নিজেকে শেখ হাসিনার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে আলবেনিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনের সময় ঢাকার কূটনৈতিকপাড়ায় পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন এবং তৎকালীন সরকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার দাবি করছেন।

তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, সোহেল রানা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ২০২১ সালে। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা ছাড়া কোনো হত্যা মামলা নেই। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, সোহেল রানা ২০২১ সালে পালিয়ে যাওয়ার পর কর্মস্থলে অনুপস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে তাকে বরখাস্ত করা হয়। ২০২২ সালে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি হয়। ইন্টারপোলের রেড নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে ১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে আলবেনিয়ায় আটক করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মার্চে তাকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে আলবেনিয়া কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়। তবে এখনো এর কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এক কর্মকর্তা বলেন, কেউ আটক হলে সংশ্লিষ্ট দেশের আইনে তার অপরাধ অনুযায়ী বিচার হয়, এখন পর্যন্ত সোহেল রানার বিরুদ্ধে কোনো রায় হয়নি, এ কারণে হয়তো তারা এখনো কিছু জানায়নি।

জানা যায়, ২০২০ সালে যখন বাংলাদেশ ই-কমার্স খাত দ্রুত বিকাশ লাভ করছিল, তখনই বনানী থানার তৎকালীন পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা, তার স্ত্রী, বোন-ভগ্নীপতি ও স্বজনদের নিয়ে গড়ে তুলেন ই-অরেঞ্জ নামে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। নানা অফারে অল্পদিনেই এর ওপর গ্রাহকদের দৃষ্টি পড়ে। কিন্তু সবকিছুর নেপথ্যে ছিল প্রতারণার মহাপরিকল্পনা। এক বছরের মাথায় গ্রাহকরা বুঝতে পারেন তারা ই-অরেঞ্জের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ততদিনে গ্রাহকদের প্রায় ১১শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১ সালে গুলশান থানায় একটি মামলা হয়। মামলায় সোহেল রানার বোন সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা আমানুল্লাহ, বিথী আক্তার, জায়েদুল ফিরোজ, নাজমুল হাসান রাসেলসহ সব স্বত্বাধিকারীকে আসামি করা হয়। এ মামলায় গ্রেফতার হন সোহেল রানার বোন সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানসহ তিনজন। তারা এখন পর্যন্ত কারাগারেই আছেন। কিন্তু ওই সময়ই সোহেল রানা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে যান। সেখান থেকে নেপালে পালানোর চেষ্টাকালে ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে গ্রেফতার হন। ভারতে অনুপ্রবেশের মামলায় সোহেল রানার দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ৪০ হাজার রুপি জরিমানা হয়। পশ্চিমবঙ্গের আলীপুরের কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন তিনি। সেখান থেকে অসুস্থতা দেখিয়ে জামিনে মুক্তির পর লাপাত্তা হয়ে যান। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের নতুন ফন্দি আঁটেন। পর্তুগাল হয়ে আলবেনিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেন।

আলবেনিয়ার শীর্ষ সংবাদমাধ্যম এমসিএন টিভি সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘পর্তুগাল থেকে আলবেনিয়ার রিনাস বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর ১ ফেব্রুয়ারি শেখ সোহেল রানাকে গ্রেফতার করা হয়। বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। তিনি ইতঃপূর্বে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়।’ সংবাদে বলা হয়, ‘সোহেল রানা দাবি করেন জুলাই আন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় আত্মরক্ষার্থে কাজ করার কারণেই তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। দেশে ফিরিয়ে আনা হলে তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।’ সোহেল রানা নিজে এমসিএন টিভির কাছে দাবি করেছেন, তিনি রাজনৈতিক কারণে দেশ ছেড়েছেন এবং গ্রেফতারের সময়ই রাজনৈতিক আশ্রয় দাবি করেছিলেন।’ সোহেল রানার আইনজীবী এডন মেক্সি সংবাদমাধ্যমটিকে জানান, ‘ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশন অনুযায়ী আলবেনিয়া কোনো নাগরিককে এমন কোনো দেশে ফেরত পাঠাতে পারে না, যেখানে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে।’

সোহেল রানার আলবেনিয়ায় গ্রেফতারের বিষয়টি নিয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খানও নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দেন। এসব খবরের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অনুসন্ধানে দেখা যায়, সোহেল রানার বিরুদ্ধে কোনো হত্যা মামলা নেই। তার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় ১১শ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও প্রতারণার মামলা, এছাড়া স্ত্রী নাজনীন নাহার, বোন সোনিয়া মেহজাবিন এবং ভগ্নীপতি মাশকুর রহমানকে আসামি করে আরও ৯টি মামলা চলছে। অভিযোগগুলো অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা ও মানি লন্ডারিংসংশ্লিষ্ট। মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় সিআইডি ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ইতঃপূর্বে ৩৫৮ কোটি টাকা পাচারের সত্যতা পেয়েছে। তারা সোহেল রানাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিটও দিয়েছে।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, শেখ সোহেল রানার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কোনো হত্যা মামলা নেই। তাছাড়া তিনি ২০২১ সাল থেকেই পলাতক। তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। তিনি হয়তো নিজেকে বাঁচানোর কোনো কৌশল অবলম্বন করেছেন।