
চট্টগ্রামের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক হেলাল উদ্দিন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পরও তিনি গত পাঁচ বছর ধরে শিক্ষকতা পেশায় আছেন। বর্তমানে তার মাসিক বেতন মাত্র আট হাজার টাকা। এই সামান্য আয়ে সংসার চালাতে না পারায় বাধ্য হয়ে তাকে টিউশনি করাতে হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে শিক্ষকতাকে অত্যন্ত মূল্যবান পেশা হিসেবে দেখা হয়, সেখানে বাংলাদেশের শিক্ষকদের জীবনধারণের চিত্র কেমন, তা শোনা যাক তাদেরই জবানিতে।
আমেরিকায় কিন্ডারগার্টেনের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের বাৎসরিক বেতন কমপক্ষে ৬০ হাজার ডলার। ডলারের রেট ১২০ টাকা ধরলে বাৎসরিক ৭২ লাখ টাকা দাঁড়ায়। অথচ বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের বাৎসরিক বেতন এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা
জীবনধারণের জন্য অন্য আয়ের পথ
শিক্ষক হেলাল উদ্দিনের ভাষ্য, ‘হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করে শিক্ষকতা করছি। পাঁচ বছর আগে ছয় হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করি। এখন বেতন মাত্র আট হাজার টাকা। এই আয় দিয়ে দেশের বাজারে পরিবার চালানো অসম্ভব। তাই বাধ্য হয়ে টিউশনির মাধ্যমে কোনোভাবে সংসার চলছে। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে ধারদেনা করতে হয়। এখন শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ নেই। যদি কেউ শুধু শিক্ষকতার ওপর নির্ভর করে, তবে না খেয়ে মরতে হবে। মোটকথা, শিক্ষকতা করতে চাইলে পাশাপাশি অন্য আয়ের পথ থাকতে হবে।’
উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, পেনশন— কোনো সুবিধাই পান না বেসরকারি শিক্ষকরা। হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বেসরকারি শিক্ষকদের শরীর যতক্ষণ চলে, ততক্ষণই বেতন। সেই বেতনও আবার অনিয়মিত। অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও কেউ খোঁজ নেয় না। চাকরির নিরাপত্তা নেই, আর্থিক সচ্ছলতাও নেই। তবুও বেকার থাকার চেয়ে ভালো আছি।’

দেশ-বিদেশের বেতনের আকাশ-পাতাল পার্থক্য
হেলাল উদ্দিন যেখানে তীব্র অর্থকষ্টে ভুগছেন, সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। ইউএস ব্যুরো অব লেবার-এর ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকায় কিন্ডারগার্টেনের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের বাৎসরিক বেতন কমপক্ষে ৬০ হাজার ডলার। ডলারের রেট ১২০ টাকা ধরলে বাৎসরিক ৭২ লাখ টাকা দাঁড়ায়। অথচ বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের বাৎসরিক বেতন এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা।
শুধু আমেরিকা নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের মাসিক বেতন সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ, ভারতের চেয়েও বাংলাদেশের শিক্ষকরা প্রায় তিনগুণ কম বেতন পান।
শিক্ষকদের অভিযোগ, বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম সুবিধাটুকুও পান না। নির্ধারিত পে-স্কেল না থাকায় বেশিরভাগ শিক্ষককে নামমাত্র বেতনে চলতে হয়। ফলে ধীরে ধীরে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে যাচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে দেশের শিক্ষা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তারা।

সংগঠনের দাবি: সরকারি অনুদান ও সহজ শর্তে ঋণ
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন, চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক মো. ইকবাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে আমাদের সংগঠনে প্রায় ১০০টি স্কুল আছে। আরও কয়েকটি সংগঠনে প্রায় এক হাজারের মতো স্কুল রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে গড়ে আটজন করে ধরলেও আট হাজার শিক্ষক কর্মরত। তাদের বেশিরভাগের বেতন ছয় থেকে আট হাজার টাকা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ব্যতিক্রম থাকতে পারে। আট-দশ হাজার টাকা দিয়ে শহরের মতো জায়গায় বসবাস করা অসম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনা মহামারির সময় অনেকদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ওই সময় শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে যায়, যার প্রভাব এখনও কাটেনি। কিন্ডারগার্টেনগুলো প্রায় ভাড়া বাসায় বা ভবনের ছাদে চলে। অনেক প্রতিষ্ঠান ঘরভাড়া না দিতে পারার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়েছেন অনেক শিক্ষক। সরকারের পক্ষ থেকে নিবন্ধনের জন্য নীতিমালা করা হলেও এর কোনো অগ্রগতি নেই। কিন্ডারগার্টেনগুলোর সুবিধার্থে সরকারি অনুদান এবং সহজ শর্তে ঋণের দাবি জানালেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা মেলেনি।’
অর্থ নেই, তবুও সম্মান ও সময়ের জন্য শিক্ষকতা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন রুবেল হোসেন। পরিবারের হাল ধরতে তিনি কক্সবাজারের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে একটি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা শুরু করেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, শিক্ষার মহান ব্রত শিক্ষকতায় অর্থনৈতিক সুরক্ষা নেই। তিনি নামমাত্র বেতনে কর্মরত আছেন কেবল সম্মান এবং সময় কাটানোর জন্য।

তার মন্তব্য, ‘বাবাকে হারানোর পর পরিবারকে সময় দিতে গ্রামে চলে আসি। পাশাপাশি একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। বেতন কম হলেও সম্মান এবং পরিবারের দেখাশোনা করার জন্য গ্রামে থাকছি। আমার বাবা প্রবাসী ছিলেন বলে আমাদের পারিবারিক অবস্থা অনেকের চেয়ে ভালো। কিন্তু যাদের অবস্থা ভালো নয়, তাদের তো পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
শিক্ষকের মর্যাদা সবার আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের পরিচালক ড. উদিতি দাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, হাইস্কুলের শিক্ষক, কলেজের শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক— সবার পরিচয় একটাই, শিক্ষক। প্রাইমারি স্কুল তো ফাউন্ডেশন। এরপর একতলা, দোতলা, তিনতলা হবে। এখানে গাঁথুনি যদি শক্ত না হয়, ওপরে তুলে লাভ নেই। প্রত্যেক শিক্ষকের প্রতি আমাদের সমান শ্রদ্ধা, মর্যাদা প্রদর্শন করা উচিত।’
‘সামাজিক ভেদাভেদ সবসময় আছে, শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপার আছে; সেগুলো বিবেচনা করে বেতন বৈষম্য না করে কাছাকাছি রাখা উচিত। শিক্ষকরা তো আর কিছু করেন না, শিক্ষকতার মতো নভেল প্রফেশনে আসেন মূলত জাতীকে কিছু দেওয়ার জন্য।’
বেতন বৈষম্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রাইমারি না পড়লে আমি আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতাম না। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের মর্যাদা সবার আগে। কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা অনেক কম বেতন পান। এটি কোনোভাবে কাম্য নয়। শিক্ষকরা যেন সসম্মানে জীবনধারণ করতে পারেন, সেজন্য একটি পে-স্কেল দরকার।’