Image description

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় অগ্রগতি হয়েছে। সনদ বাস্তবায়নে জনগণের মতামত গ্রহণের লক্ষ্যে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে পৌঁছেছে। বিএনপি বলছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য রেফারেন্ডাম (গণভোট) ব্যাপারটি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের দিন একইসঙ্গে করা যায়। সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটে কোনো বাধা নেই। সনদে কী থাকবে তা জনগণের কাছে উন্মুক্ত থাকবে। জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে, এটা গণভোটে দিতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজন হলে, এটা জনগণের জন্য একটু কনফিউজিং হবে। মানুষ গণভোটের উপর একটি রায় দেন, সেটা হ্যাঁ এবং না। সেক্ষেত্রে নভেম্বরের শেষে বা ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটের পাশাপাশি গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট থাকবে। যেখানে সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে জনগণ মতামত দেবে। গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফার চতুর্থ দিনের আলোচনা শেষে এমনটাই জানিয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

বৈঠক শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। তাদের মতামত গ্রহণের জন্য একটি গণভোট আয়োজনের ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দল একমত হয়েছেন।

এটি একটি বড় ধরনের অর্জন জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী অন্যান্য বিষয়েও ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারবো। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মধ্যদিয়ে যে আইনসভা তৈরি হবে সেই আইনসভা সংবিধান সম্পর্কিত মৌলিক সংস্কারগুলো করতে পারে। এই আইনসভাকে এমন বৈশিষ্ট্য দেয়া দরকার- যাতে করে এই সংস্কারগুলো সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন যেন জুলাই সনদের ভিত্তিতে টেকসই হয়। সেই ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যত ঐকমত্য হয়েছে।
ইতিমধ্যে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে মতামত নিতে বলা হয়েছিল উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, এখন অনেক দল এমন বলছেন, ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে। 

সনদ স্বাক্ষরের জন্য দলগুলোর প্রতিনিধিদের নাম পাঠানোর প্রস্তাব করেছিলাম জানিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, তিন-চতুর্থাংশ দলের নাম পেয়েছি। যারা এই সনদে স্বাক্ষর করবেন। আমরা অনুরোধ করেছি, এখনো যেসব দলের পক্ষ থেকে নাম পাওয়া যায়নি। আশা করছি, কয়েকদিনের মধ্যেই তারা নামগুলো দেবেন। ৮ই অক্টোবর বিকালে আমরা আবার বসবো। 
বৈঠক শেষে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য রেফারেন্ডাম (গণভোট) ব্যাপারটি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের দিন একইসঙ্গে করা যায়। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জনগণের রায় নেয়ার জন্য সংসদ নির্বাচনের দিন আলাদা ব্যালট রাখার কথা বলেছি।

তিনি বলেন, আজকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সব রাজনৈতিক দলকে আলোচনার জন্য ডেকেছিলেন। বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় একটা ফাইনাল স্টেজে আমরা আছি। সর্বশেষ যে রিকমেন্ডেশন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রেরণ করা হবে, সেই বিষয়ে আমরা একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এ বিষয়ে আজকের আলাপ-আলোচনার মধ্যদিয়ে মোটামুটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে মনে হয় আমরা এগোতে পেরেছি।
সালাহউদ্দিন বলেন, সমগ্র জনগণের কাছে আমরা যদি এই সম্মতিটা নেই যে, আমরা রাজনৈতিক দলগুলো এভাবে জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি; জনগণ তার পক্ষে আছে কিনা। তখনই হবে জনগণের পক্ষ থেকে এই জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি চূড়ান্ত অভিমত, যা সার্বভৌম ক্ষমতার একটি রায়।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির এই নেতা বলেন, জাতীয় সনদের যে অংশগুলোতে আমরা পুরোপুরিভাবে ঐকমত্য হয়েছি (কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতভিন্নতা বা ডিসেন্ট আছে); জনগণ যদি তার পক্ষে রায় দেয়, তবে সেটা বাস্তবায়ন করতে পরবর্তী সংসদের সমস্ত সংসদ সদস্য বাধ্য থাকবেন। সেই জন্য আমরা সংসদ নির্বাচনের দিন আলাদা একটি ব্যালটে জুলাই জাতীয় সনদের পক্ষে জনরায় নেয়ার জন্য বলেছি। এই গণভোট (রেফারেন্ডাম) অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের সংবিধানে কোনো সংশোধনী আগে আনতে হবে না।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এই পয়েন্টে সবাই এখন একমত। সব দলই প্রায় কাছাকাছি এসেছে- জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে, এটা গণভোটে দিতে হবে। এই জায়গায় এসে কারও কারও একটু দ্বিমত আছে। 

তিনি বলেন, আমাদের ধারণা এই পয়েন্টেও আমরা একমত হয়ে যাবো। এসময় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, নির্বাচন কমিশনকে যদি সরকার দায়িত্ব দেন।  আমরা মনে করি এটা জাতীয় নির্বাচনকে কোনো ধরনের ডিস্টার্ব করা ছাড়াই, নভেম্বরের শেষে বা ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই করতে পারবে। 
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। কারণ পরবর্তী সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তা বাদ দিয়ে দিতে পারে। তাই জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী এ সরকারকেই বিষয়টি সমাধান করতে হবে।

তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটের পাশাপাশি গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট থাকবে। যেখানে সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে জনগণ মতামত দেবে। এ বিষয়ে অধিকাংশ দল একমত হয়েছে।
তুষার বলেন, ভাষাগত ভিন্নতা বাদ দিলে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে দলগুলো মোটামুটি একমত। যেখানে সনদ বাস্তবায়নে জনগণ হ্যাঁ বা না ভোট দেবে। নোট অব ডিসেন্টে যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে, সেগুলোকেও ‘একমত’ বলে ধরে নিতে হবে। এক্ষেত্রে লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কের বিষয়টিও অনুসরণ করা যেতে পারে। আমরা মনে করি সব রাজনৈতিক দল একমত হলে জনগণ জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার পক্ষে রায় দেবে।

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ৮০ শতাংশ ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার রাখে। বাকি ২০ শতাংশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বৈঠকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী,  জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ২৮টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

খুব শিগগিরই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে ঐকমত্য কমিশন: খুব শিগগিরই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। গতকাল সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশন সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠকে এ কথা বলেন তিনি। 

কমিশন সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস কমিশনের সকল সদস্যদের ধন্যবাদ ও শুভ কামনা জানিয়েছেন। কমিশনের কাজের চূড়ান্ত অগ্রগতি সম্পর্কে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাকে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন।  
বৈঠকে কমিশনের পক্ষ থেকে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ, কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
পাশাপাশি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আসিফ নজরুল ও আদিলুর রহমান খান বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।