দেশে ১৮ লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সারে ভুগছে। এসব রোগীর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশের চিকিৎসার এক পর্যায়ে রেডিওথেরাপি নিতে হয়। অথচ ঢাকার সরকারি হাসপাতালের একটিতেও রেডিওথেরাপির কোনো যন্ত্র সচল নেই। এতে সরকারি পর্যায়ে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিকিরণ সেবা (রেডিওথেরাপি) বন্ধ রয়েছে।
ঢাকার বাইরে যে সাতটি সরকারি হাসপাতালে রেডিওথেরাপির যন্ত্র রয়েছে, এর মধ্যে চারটি চালু রয়েছে, চারটি অচল ও তিনটি অব্যবহূত অব্যবস্থায় পড়ে আছে। এতে সারা দেশে ক্যান্সার চিকিৎসায় সংকট দেখা দিয়েছে। সময়মতো থেরাপি না পেয়ে আক্রান্ত রোগীদের ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ছে এবং মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।
ক্যান্সার রোগীদের একটি বড় অংশ চিকিৎসা নেয় জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। এখানে সচল থাকা সর্বশেষ যন্ত্রটিও গত ২১ ডিসেম্বর থেকে অচল হয়ে পড়ে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে থাকা দুটি যন্ত্র অচল হয়েছে ছয় মাসের বেশি সময় আগে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার বিভাগ রয়েছে, তবে রেডিওথেরাপির যন্ত্র নেই।
সরকারি হাসপাতালে বিকিরণ ব্যবস্থাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সামর্থ্যবানরা বেসরকারি হাসপাতালে ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি টাকা দিয়ে বিকিরণ সেবা নিচ্ছে। তবে নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে এই সেবা নেওয়া অসম্ভব। তাদের ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া উপায় নেই।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্যান্সারের চিকিৎসায় বহুল ব্যবহূত চিকিৎসা পদ্ধতির একটি রেডিওথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপি। ক্যান্সারের ধরনের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসকরা এই থেরাপির পরামর্শ দেন।এর সাহায্যে ক্যান্সারের কোষ মেরে ফেলা হয়। দেখা যায়, ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রে কোনো না কোনো সময় রেডিওথেরাপি প্রয়োজন হয়।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি অব রেডিয়েশন অনকোলজিস্টের মতে, ‘আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য অন্তত একটি রেডিওথেরাপি যন্ত্র দরকার। সেই হিসেবে আমাদের ১৬০টি থেকে ১৮০টি রেডিওথেরাপি যন্ত্র প্রয়োজন। আমাদের চিকিৎসকের সংখ্যাও অপ্রতুল। সারা দেশে অনকোলজিস্টের সংখ্যা সাকল্যে ২৮০ জনের মতো। আমাদের কমপক্ষে দেড় হাজার দরকার।’
বিশেষায়িত হাসপাতালেও ব্যবস্থা নেই
ক্যান্সারের রোগীদের জটিলতা অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হয় বিশেষায়িত হাসপাতালে। অথচ এসব হাসপাতালের কোনোটিতেই রেডিওথেরাপির ব্যবস্থা নেই। বিশেষায়িত এসব হাসপাতালের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট, জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইডিসিএইচ), জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।
সম্প্রতি ক্যান্সারবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন বলেন, একটা সময় দেশে পুরুষদের ফুসফুস ক্যান্সারের রোগী বাঁচত গড়ে দেড় বছর। এখন বাঁচে গড়ে আট বছর। প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হলে আরো বেশি সময় বাঁচে। এর কারণ আমাদের আধুনিক রেডিও থেরাপি যন্ত্র।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দেশে ক্যান্সার রোগীদের রেডিওথেরাপি দেওয়া হয় মূলত দুই ধরনের মেশিনে। একটি কোবাল্ট মেশিন, অন্যটি লিনিয়ার মেশিন।
সরকারি হাসপাতালে নতুন কোবাল্টে দিনে ২০০ জন রোগীর থেরাপি দেওয়া যায়। লিনিয়ার মেশিনে দিনে থেরাপি দেওয়া যায় ১০০ জনকে। সরকারি হাসপাতালে কোবাল্ট মেশিনে রেডিওথেরাপির জনপ্রতি খরচ ১০০ টাকা। এর সঙ্গে জনপ্রতি প্ল্যানিং খরচ এক হাজার ৫০০ টাকা। লিনিয়ার মেশিনে খরচ ২০০ টাকা। এর সঙ্গে প্ল্যানিং খরচ এক হাজার ৫০০ টাকা।
অন্যদিকে শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ক্যান্সার হাসপাতালে লিনিয়ার মেশিনে বর্তমানে জনপ্রতি রেডিওথেরাপির খরচ সাড়ে চার হাজার থেকে আট হাজার টাকা। এর সঙ্গে প্ল্যানিং খরচ ৫১ হাজার ৫০০ থেকে ৭৯ হাজার টাকা। নাম না প্রকাশ করার শর্তে ওই হাসপাতালের এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানান।
ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালে রমরমা ব্যবসা
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে রেডিওথেরাপি বন্ধ থাকায় বেশির ভাগ রোগী যাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালে। অথচ ঢাকায় কয়েক বছর আগেও তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে মাত্র চারটি রেডিওথেরাপি যন্ত্র ছিল। বর্তমানে ছয়টি হাসপাতালে ১৫টি বিকিরণ যন্ত্র চালু আছে।
ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি পর্যায়ে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বিকিরণ যন্ত্র ছয়টি। এর মধ্যে লিনিয়ার এক্সিলারিটর চারটি এবং কোবাল্ট-৬০ দুটি। সব কটি এখন বিকল হয়ে পড়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুটি, বগুড়া, ময়মনসিংহ, রংপুর ও বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একটি করে যন্ত্র থাকলেও সব কটি বর্তমানে বিকল। রাজশাহী, ফরিদপুর ও খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একটি করে লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহূত অবস্থায় পড়ে আছে। তবে চট্টগ্রাম ও সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দুটি যন্ত্র ও পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাভারে একটি যন্ত্র চালু আছে।
ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে রাজধানীর ডেলটা হাসপাতালে বিকিরণ যন্ত্র আছে পাঁচটি। আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালে আছে তিনটি। ইউনাইটেড হাসপাতালে দুটি, ল্যাবএইড হাসপাতালে দুটি, সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুটি এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে একটি যন্ত্র রয়েছে।