হাফিজুর রহমান হাফিজ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় হাতে পেয়েছিলেন আলাদিনের চেরাগ। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সময় হাফিজ ছিলেন রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ নওহাটা পৌরসভার মেয়র। পাশাপাশি পবা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর আসনের) সাবেক সংসদ-সদস্য আয়েন উদ্দিনের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন হাফিজ। দলীয় প্রভাব, মেয়রের ক্ষমতা আর সাবেক সংসদ-সদস্যের আশীর্বাদে অবিশ্বাস্য উত্থান ঘটে তার। মাত্র এক দশকের মধ্যেই হাফিজ জমি, মার্কেট, গাড়ি, ফ্ল্যাট, পুকুর, গরুর খামার এবং মামলা বাণিজ্যসহ নানান অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত থেকে অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক বনে যান।
হাফিজের প্রতিবেশী নওহাটা পৌরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মনির হোসেন। তিনি জানান, হাফিজের বাবা কফিল উদ্দিন মোল্লা আশির দশকে জীবন-জীবিকার তাগিদে শূন্যহাতে পাবনার কাশিনাথপুর থেকে নওহাটার পূর্ব পুঠিয়াপাড়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। সেসময় কফিল উদ্দিন ধারকর্য করে হাঁড়িপাতিলের ব্যবসা শুরু করেন। পরে স্থানীয় একটি চালকলে দীর্ঘদিন শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন। হাফিজ ছাত্রলীগের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন। ছিলেন রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ২০১৪ সালে আয়েন উদ্দিন রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ-সদস্য হলে হাফিজকে তিনি নওহাটা পৌরসভা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। পরে তিনি সভাপতি হিাসবেও দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে পবা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েন উদ্দিন সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর হাফিজকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাথার ওপরে আয়েনের হাত থাকায় নওহাটা পৌরসভাসহ পুরো পবা উপজেলার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন তিনি। প্রথমেই শুরু করেন পুকুরখনন বাণিজ্য। উচ্চ আদালতের নির্দেশে কৃষিজমিতে পুকুর খননে বিধিনিষেধ থাকলেও এ কাজ করে ১০ বছরে হাফিজ স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
নওহাটা পৌরসভার বাগধানি এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি আতর আলী। তিনি জানান, হাফিজ পুরো পবা উপজেলায় পুকুর খননের দালালি করেন। পাশাপাশি তিনি বাগধানি এলাকায় নিজেই ৩০৬ বিঘা জমিতে ২৫টি পুকুর খনন করে মাছচাষ করেন। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পুকুরের জন্য এলাকার মানুষের জমি একরকম জবরদখল করেছেন। অনেকেই লিজের টাকা দেননি। জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে নালিশ দিয়েও পাননি টাকা। মাছচাষে হাফিজ প্রায় ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এছাড়া পাশেই ছয় বিঘা জমি কিনে গরুর খামার করেছেন। জমি কেনাসহ খামারে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় চার কোটি টাকা। শাহীন আলী নামের পৌরসভা সদরের একজন বাসিন্দা জানান, হাফিজ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নওহাটা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। এরপরই তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার দাপটে শুরু করেন পৌরসভার তহবিল তছরুপ। পৌরসভার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ঠিকাদারি কাজ নিজের লোকজন দিয়ে করান হাফিজ। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে নেন বড় অঙ্কের কমিশন। বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে পৌরসভার পশুহাট ইজারা দেন। এ ইজারার প্রায় আড়াই কোটি টাকা পৌরসভার তহবিলে জমা না দিয়ে হাফিজ আত্মসাৎ করেন। হাফিজ নওহাটা পৌরসভা, পবা উজেলার বিভিন্ন এলাকা এবং রাজশাহী মহানগরীতে জমি ও ফ্ল্যাট কিনেছেন। তৈরি করেছেন মার্কেট। নওহাটা সদরের কাজী মোর্ত্তজা আলী জানান, হাফিজ পৌর সদরের প্রাণকেন্দ্র অগ্রণী ব্যাংকের পাশে ২০২৪ সালে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকা দিয়ে সাড়ে চার কাঠা জায়গা কিনেছেন। এরপর দেড় কোটি টাকা দিয়ে বানিয়েছেন মার্কেট। ওই মার্কেটে হাফিজের একটি কাপড়ের দোকান আছে। সেখানে প্রায় ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
তিনি জানান, হাফিজ তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন। ওই তিনটিসহ উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য করে তিনি দুহাতে অঢেল টাকা কামিয়েছেন। পবা উপজেলার আলাই বিদিরপুরে রহমান জুটমিলসংলগ্ন রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা দিয়ে এক বিঘা জমি কিনেছেন। এছাড়া রাজশাহী মহানগরীতে রয়েছে তার দুটি ফ্ল্যাট। বর্তমান বাজারে এ দুটি ফ্ল্যাটের মূল্যও কোটি টাকার বেশি। এছাড়া হাফিজের ২৮ লাখ টাকা মূল্যের রয়েছে একটি মাইক্রোবাস।
নওহাটা পৌরসভার দুইবারের নির্বাচিত সাবেক মেয়র এবং পৌরসভা বিএনপির সাবেক সভাপতি মকবুল হোসেন জানান, হাফিজ মেয়র হয়ে পৌরসভাকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন। পৌরসভার তহবিল অবাধে লুটপাট করেছেন। পৌরসভার ঠিকাদারি কাজ তার লোকজন করতেন। পশুহাট ইজারার টাকা পৌর তহবিলে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। তিনি বলেন, আমি ২০২১ সালে মেয়রের দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় পৌর তহবিলে প্রায় তিন কোটি টাকা রেখে এসেছিলাম। এখন পৌর তহবিল শূন্য। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সময়মতো বেতন হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ এবং তছরুপের অভিযোগে আমরা হাফিজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরই হাফিজ জনরোষ এবং গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপন করেন। তার নামে পবা থানায় দুটি মামলা হয়েছে। এ কারণে তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, হাফিজকে গ্রেফতারে পুলিশ কাজ করছে।