Image description

পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তাঁরা বলছেন, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছা লাগবে। তা না হলে এসব সংস্কার প্রস্তাব মূল্যহীন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া আরো কিছু বিষয় সংযোজন করা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন তাঁরা। যেমনপুলিশ কমিশনে সরকারি দল কিংবা বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের না রাখতে মত দিয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া পৃথক তদন্ত সংস্থায় পুলিশের সঙ্গে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের তদন্তকারীদের রাখার বিষয়েও জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত বছর ৩ অক্টোবর পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। আর গত বুধবার (১৫ জানুয়ারি) পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন।প্রতিবেদনে পুলিশ সংস্কার কমিশন ১৫টি বিষয়ে ১০৭টি সুপারিশ করেছে। বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, পুলিশ কর্তৃ বল প্রয়োগ, আটক, গ্রেপ্তার, তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ, মানবাধিকার, প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গঠন, থানায় জিডি রেকর্ড, মামলা রুজু, তদন্ত ও পুলিশ ভেরিফিকেশন, যুগোপযোগী আইন ও প্রবিধানমালা, পুলিশের দুর্নীতি ও প্রতিকার, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও চলমান ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, প্রশিক্ষণ সক্ষমতা, নারী, শিশু ও জেন্ডার সচেতনতা, পুলিশের কল্যাণ ও কর্ম পরিবেশ, নিয়োগ বদলি ও পদোন্নতি, পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা বা ইউনিট শক্তিশালীকরণ, জনকেন্দ্রিক ও জনবান্ধব পুলিশিং এসব সুপারিশ।

এসব সুপারিশের বিষয় নিয়ে কথা হলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশন থেকে আমাদের ডাকা হয়েছিল। আমরা আমাদের মতামত দিয়েছিলাম।কিন্তু সব মতামত সংস্কার প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়নি। হওয়া দরকার ছিল।

তিনি বলেন, একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন করার কথা বলা হলেও সেখানে সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের রাখার প্রস্তাব রয়েছে। আমরা মনে করি, তাহলে সংস্কারের যে উদ্দেশ্য, তা সফল হবে না। সংসদ সদস্যরা তো পলিসি মেকিংয়ে থাকবেন, তাঁদের পুলিশ কমিশনে থাকতে হবে কেন?

তিনি আরো বলেন, সংস্কার প্রতিবেদনে পৃথক তদন্ত সংস্থার কথা বলা হয়েছে।সেই সংস্থায় মামলা তদন্তের জন্য পুলিশের পাশাপাশি প্রাইভেট সংস্থার তদন্তকারী যুক্ত হতে পারে। তাহলে তদন্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকবে। পাশের দেশ ভারতেও প্রাইভেট তদন্তকারী রয়েছে।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ সার্ভিসের পুলিশ সুপার, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদায়নের জন্য ফিটলিস্ট প্রস্তুত করে নিয়মিত বিরতিতে হালনাগাদ করতে হবে। হালনাগাদ তালিকা থেকে পুলিশ সুপার ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদায়ন করতে হবে।

এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। জেলা প্রশাসকের ক্ষেত্রে ফিটলিস্ট করা হয়। একজন এসপি ও একজন ওসি কটি স্টেশনে কত দিন দায়িত্ব পালন করবেন তা নির্ধারিত হওয়া দরকার। আমি মনে করি, একজন এসপিকে সর্বোচ্চ দুটি জেলার এসপি এবং ওসির ক্ষেত্রে তিনটি থানার বেশি দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। এতে করে যাঁরা এসপি ও ওসি পদপ্রত্যাশী তাঁদের অসন্তোষ কমবে। 

আর এ বিষয়ে ওমর ফারুক বলেন, শুধু ফিটলিস্টই নয়, বিভিন্ন দেশে যেমন পুলিশের পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর রয়েছে, ফিটলিস্টের সঙ্গে পদায়নের ক্ষেত্রে সেটাও বাস্তবায়ন করতে হবে।

প্রতিবেদনে পুলিশের দুর্নীতি রোধে সর্বদলীয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, পুলিশের কাজকর্মে ইচ্ছাকৃত দুর্নীতি রোধে স্বল্পমেয়াদি একটি কার্যক্রম হিসেবে ওয়াচডগ বা ওভার সাইট কমিটি গঠন করা যেতে পারে। প্রতিটি থানায় সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে স্থানীয় পর্যায়ে ওভার সাইট বডি হিসেবে কাজ করবে এবং দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নূর মোহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, অবশ্যই এই সুপারিশগুলো ভালো। আমার সময়ে ওপেন হাউস ডে করেছিলাম। যেখানে থানার পুলিশ, এলাকার গণ্যমান্য বক্তিরা মতবিনিময় করতেন। এতে কাজের স্বচ্ছতা বেড়েছিল।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কমিশনের প্রতিবেদনে স্বচ্চ কাচঘেরা কক্ষ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়ে নূর মোহাম্মদ বলেন। প্রস্তাবটি ভালো। তবে সেটি রাজনৈতিক সরকার রাখবে কি না, সেটার ওপর বিষয়টি নির্ভর করছে। রাজনৈতিক সরকার এসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন না করলে সবই জলে যাবে।

তিনি বলেন, পুলিশের সবাই ভালো ইন্টারোগেশন করতে পারে না। এ কারণে স্পেশালিস্ট দরকার হয়। কথা হলো পুলিশের সেই সময় আছে কি না। সাধারণ প্র্যাকটিস হিসেবে দেখা যায়, গ্রেপ্তারের পরই আসামিকে মারধর করে তথ্য বের করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু নিয়মটা হলো একজন অপরাধীর কাছ থেকে প্রকৃত তথ্য পেতে সময় দিতে হবে। কিন্তু হয় উল্টোটা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাড়াতাড়ি তথ্য বের করতে মারধরের হাত থেকে বাঁচতে পুলিশ যা জানতে চায় আসামি তা স্বীকার করে।

বিষয়টি নিয়ে ওমর ফারুক বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে কাচঘেরা কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদের নজির আছে। এটি করলে ভালো হবে। নিরপরাধ মানুষ নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

কমিশনের সুপারিশে পুলিশের বল প্রয়োগের (অনুমোদন ছাড়া সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভ) ক্ষেত্রে পাঁচ ধাপের একটি পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে।

এ সম্পর্কে নূর মোহাম্মদ বলেন, যে সুপারিশগুলো করা হয়েছে তা কিন্তু আগে থেকেই আছে। যেমনপুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিংয়ের সময় তাদের ক্রাউড কন্ট্রোল এর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ অনুযায়ী কোনো একটি অনুমোদনহীন সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে মাইকিং করে জানাতে হবে এটি অনুমোদনহীন সমাবেশ, সুতরাং সবাই যেন চলে যায়। সেটি না মানলে দ্বিতীয় ধাপে লাঠিপেটা করতে হবে। এর পরও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও জল কামান ব্যবহার করতে হবে। আর সবশেষে শর্টগানের গুলি ব্যবহারের কথা বলা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১০০ গজ দূর থেকে গুলি করতে হবে। যেন গুলি কারো গায়ে বিদ্ধ হলেও মৃত্যু না হয়। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে আমরা দেখলাম ১০ হাত দূর থেকে শর্টগানের গুলি করা হয়েছে। তাহলে প্রশিক্ষণ তো কাজে লাগল না কিংবা মানা হলো না।

তিনি আরো বলেন, রাজনীতিকরা গত ১৫ বছর পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। একটা নীতিই তারা গ্রহণ করেছিল, রাস্তায় বিরোধী মতের কাউকে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না। এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে পুলিশ বাহিনীকে। এর জন্য তৈরি করা হয়েছে কিছু অফিসার। ওই অফিসাররা একটা সময় বুঝতে পারেন, সরকার (আ. লীগ) যদি সারভাইভ করতে না পারে তবে তারাও পার পাবে না। এ কারণে তারা পেশাদারির বাইরে গিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু পুলিশের না বলার সময় এসেছে এখন। পুলিশকে বলতে হবে অবৈধ কোনো আদেশ তারা মানবেন না।