রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট কাগজে আছে, কিন্তু বাস্তবে নেই। অথচ নির্মাণকাজ শেষ দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিলও পরিশোধ করা হয়েছে। আবার রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট বাস্তবে থাকলেও কাগজে ‘নেই’। তাই আবার নতুন করে বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে।
পিরোজপুর জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) বিভিন্ন নির্মাণকাজে এসব ঘটনা ঘটে। মাত্র তিন বছরের মধ্যে এই জেলায় এভাবে পুকুর চুরির ঘটনা ঘটেছে। আত্মসাত্ করা হয়েছে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। এলজিইডির তদন্তে এসব অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে বলে জানিয়েছেন প্রধান প্রকৌশলী। সচিবালয়ে আগুন লাগার পর পিরোজপুরের এলজিইডির দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘পিরোজপুর জেলায় বিভিন্ন প্রকল্পে যে বরাদ্দ দেওয়া হতো, সেখানে অর্থ লুটপাটের প্রাথমিক প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এর সঙ্গে সাবেক মুখ্য সচিবের প্রাথমিক সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তদন্ত এখনো চলছে। তদন্তের ফাইলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পিরোজপুর জেলা থেকে আবার ফাইলগুলো রিকভার করতে পারব বলে তিনি জানিয়েছিলেন।এর পরই পিরোজপুরে এলজিইডির দুর্নীতি নিয়ে জানার আগ্রহ জাগে সবার।
এলজিইডির নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, পিরোজপুর জেলায় ১৬টি প্রকল্পে ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে দুই হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ৪৭৩ কোটি টাকার বিল পরিশোধের তথ্য মিলেছে। বাকি এক হাজার ১০১ কোটি টাকার কোনো হদিস নেই। অর্থাত্ এই অর্থ ব্যয় হলেও কোথায় কোন রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ নির্মাণ, পুকুর খনন বা ঘাটলা নির্মাণে ব্যয় হয়েছে, এর কোনো নথি নেই পিরোজপুরের নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর বা প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়েও। এলজিইডির কর্মকর্তারা বলছেন, এই টাকা আত্মসাত্ করা হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতি ঢাকতে নথি পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
এলজিইডির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মূলত পিরোজপুরের এলজিইডির দুর্নীতি শুরু হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে এই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন পিরোজপুর ও ভাণ্ডারিয়ার মাঠ পর্যায়ের এলজিইডির কর্মকর্তারা। দুর্নীতির মাত্রা বাড়ে, যখন এই দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখে প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তর।
এলজিইডির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, শুধু তিন বছরে এলজিইডির এই ভয়াবহ আত্মসাত্। টানা ১০ বছরের হিসাব করলে দুর্নীতির আরো প্রমাণ মিলবে।
তদন্ত কমিটির অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্য দিয়ে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘এত ভয়াবহ দুর্নীতির কৌশল জীবনে দেখিনি। সংশ্লিষ্ট শাখাপ্রধানের অনুমোদন না নিয়েই অফলাইনে দরপত্র আহ্বানের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অফলাইনে আহ্বান করা দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকল্প পরিচালক থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়নি। কাজ শুরু না করেও কাজের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে এবং বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ক্যাশ বই, বিল রেজিস্টার, চেক রেজিস্টার, অর্থ ছাড়ের পত্র (জিও) সংরক্ষণ, পরিমাপ বই, ভ্যাটের চালান, আয়করের চালান ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হয়নি। তথ্য গোপন রাখতে বিল কপিতে অর্থনৈতিক কোড ও প্রকল্পের নামও লেখা হয়নি।
এ ছাড়া স্যালভেজ মালপত্রের মূল্য কর্তন, রোলার ভাড়া কর্তন, পাইল লোড টেস্ট, নির্মাণসামগ্রীর টেস্ট রিপোর্ট এবং সময় বর্ধনের বিষয়গুলো নথিতে রাখা হয়নি। বেশির ভাগ নথিতে দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন এবং চুক্তিপত্রও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
প্রকল্প শেষ হলেও ২৯৩টি প্যাকেজের মধ্যে ২৯টি প্যাকেজের কাজ শুরুই হয়নি, এ ছাড়া ১২১টি প্যাকেজের কাজ এখনো চলছে। কোনোটি আংশিক শেষ হয়েছে। কিন্তু এসব কাজের অর্থ ব্যয় হয়ে গেছে।
নির্মাণকাজ শেষ দেখিয়ে টাকা লোপাট : এলজিইডির প্রকল্পের নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলা থেকে আওড়াবুনিয়া (পূর্ব পৈকখালী থেকে মালিয়ার হাট জিসি রোড) সড়কে বক্স কালভার্টের কাজ শেষ হয়েছে দেখিয়ে বিল তুলে নেন ঠিকাদার। কাজ সম্পন্ন হওয়ার প্রত্যয়ন দেন পিরোজপুরের তত্কালীন নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার হাওলাদার। অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর সম্প্রতি সরেজমিনে এলজিইডির কর্মকর্তারা গিয়ে দেখেন, সেখানে কোনো কাজই হয়নি। অথচ কাজের ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে দেখিয়ে ৮৫ শতাংশ টাকা তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার।
আবার ভাণ্ডারিয়া থেকে চরখালী-মঠবাড়িয়া আরএইচডি রোড থেকে মাদার্শি পর্যন্ত মানিকমিয়া কলেজ রোডে বক্স কালভার্ট ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে দেখিয়ে ৮৬ শতাংশ টাকা তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো কাজই হয়নি। একইভাবে ভাণ্ডারিয়া পূর্ব ধাওয়া রোডে ১৩ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ব্রিজের কাজ ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে দেখিয়ে ৯৫ শতাংশ টাকা তুলে নেন ঠিকাদার। কিন্তু এখানে কোনো ব্রিজের কাজই হয়নি। মাটিভাঙ্গা থেকে কাঁঠালিয়া বর্ডার রোড পর্যন্ত দুই কিলোমিটারেরও বেশি (বিটুমিনাস কার্পেটিং) রাস্তা উন্নীতকরণের তিন কোটি ২০ লাখ টাকার বরাদ্দ হয়। কাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে দেখিয়ে ৯৪ শতাংশ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। অথচ কোনো কাজই হয়নি। এমন অনিয়ম করে টাকা আত্মসাত্ হয়েছে কয়েক শ প্রকল্পে।
আবার একই রাস্তায় একাধিক প্রকল্পের কাজ দেখিয়েও টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। বরিশাল বিভাগ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় চরখালী মঠবাড়িয়া, আরএইচডি রোড থেকে তালুকদার বাড়ি পর্যন্ত চারটি কালভার্ট করা হয়। ২০১৫ সালে শুরু হয়ে ২০১৯ সালে শেষ হয়েছে। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরের অন্য একটি প্রকল্প ‘পিরোজপুর জেলা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় একই সড়কে চারটি কালভার্ট করা হয়েছে দেখিয়ে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
যেসব প্রকল্পে অনিয়ম : পিরোজপুর জেলায় গত তিন বছরে এলজিইডির ১৬টি প্রকল্পের বিভিন্ন কাজ হবে বলে টাকা বরাদ্দ নেওয়া হয়। জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে রাস্তা, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণে।
‘দক্ষিণাঞ্চলের লোহার সেতু পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পে’ এই জেলায় ব্যয় হয়েছে ৭৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। কিন্তু ৪৯৪ কোটি ১৬ লাখ টাকার কাজের হিসাব পাওয়া গেছে। বাকি ২৬৩ কোটি ৭১ লাখ টাকার কাজের কোনো হিসাব নেই। এই কাজ কোথায় হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কি না তার কোনো নথিই নেই পিরোজপুর জেলা এলজিইডির কার্যালয়ে।
এলজিইডির কর্মকর্তারা বলছেন, কাজ না করেই টাকা তুলে নেওয়ায় এমনটি হয়েছে।
‘পিরোজপুর জেলা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে’ তিন বছরে ৪২০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। এর মধ্যে ১৬৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকার কোনো হদিস নেই। কাজ না করেই এই অঙ্কের টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারের হাতে। ‘বরিশাল বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়ক প্রশস্তকরণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে’ ৫৮০ কোটি ৭৫ লাখ ব্যয় হয়েছে পিরোজপুর জেলায়। মাত্র ১০৬ কোটি ৬০ লাখ টাকার হিসাব মিলেছে। বাকি টাকার হদিস নেই।
এ বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক আদনান আক্তারুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালক শুধু পোস্ট অফিসের কাজ করেন। এই টাকার মালিক জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী। তিনিই টাকা পরিশোধ করে থাকেন। এই অনিয়মে আমাদের কোনো দায় নেই।’
‘সাইক্লোন আম্ফান ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ অবকাঠামো পুনর্বাসন প্রকল্পে’ ২৭৭ কোটি ৬৬ লাখ ব্যয় হলেও মাত্র ৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার কাজের হিসাব আছে। বাকি টাকার হিসাব নেই।
‘উপজেলা টাউন (নন-পৌরসভা) মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন এবং মৌলিক অবকাঠামো উন্নয়নের’ নামে ২১ কোটি ৬৬ লাখ টাকার মধ্যে ১০ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ের হিসাব আছে। বাকি টাকার হিসাব নেই এলজিইডি অফিসে।
‘গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে’ ৭৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় হলেও কাগজে তথ্য রয়েছে ৩২ কোটি ১৪ লাখ টাকার। ‘উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম সড়কে ১০০ মিটারের কম দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণ প্রকল্প’ থেকে ৭২ কোটি ৭১ লাখ টাকা ছাড় হলেও হিসাব মিলেছে ৫৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকার। ‘বন্যা ও দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো পুনর্বাসন প্রকল্পে’ ১৮ কোটি ৯১ লাখ ব্যয় হলেও হিসাব আছে ১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার। ‘দেশব্যাপী পুকুর, খাল উন্নয়ন প্রকল্পে’ ১৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয় হলেও হিসাব আছে ১১ কোটি ৩৬ লাখ টাকার। ভয়াবহ অনিয়ম হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে (বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলা)।
এ বিষয়ে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্ব) গোপাল কৃষ্ণ দেবনাথ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। মন্ত্রণালয়ও পৃথক তদন্ত করেছে। এলজিইডির তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে।’
দীর্ঘদিন ধরে এভাবে অনিয়ম চলছে, কেন আগে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পিরোজপুরে অনিয়ম হয়েছে, সেটা আমরাই আগে জেনেছি। সে আলোকেই তদন্ত করেছি।’