
এশিয়ার উন্নত দেশ জাপানের ক্রমবর্ধমান শ্রমবাজারে দক্ষ বিদেশি জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের তরুণরা তথ্যপ্রযুক্তি ও বিভিন্ন পেশাগত দক্ষতায় এগিয়ে রয়েছেন।
তাদের জাপানি ভাষায় দক্ষ করে তোলার মাধ্যমে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব, যা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক হবে।
অভিযোগ রয়েছে দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতা ও বিগত সরকারগুলোর যথাযথ উদ্যোগের অভাবে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে শ্রম রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২৮ থেকে ৩০ মে জাপান সফরকালে দেশটির সরকারের কাছ থেকে আগামী পাঁচ বছরে এক লাখ শ্রমিক পাঠানোর প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন।
প্রতিশ্রুতি পেলেও এ সময়ের মধ্যে এক লাখ শ্রমিক আদৌ পাঠানো সম্ভব হবে কি-না তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এক্ষেত্রে সরকারের সামান্য উদ্যোগই এটা সম্ভব করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ অনেক দক্ষ বাংলাদেশি কর্মী শুধুমাত্র ভিসা জটিলতার জন্য জাপান থেকে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
অনেকে ১০-১২ বছর থাকার পরও কেবলমাত্র ওভারস্টে করার কারণে অভিবাসন পুলিশের হাতে আটক হয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। এ সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। ৩০ হাজারেরও বেশি জাপান ফেরত বাংলাদেশি রয়েছেন।
তারা একাধারে জাপানি ভাষায় পারদর্শী, জাপানি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত এবং সর্বোপরি জাপানের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করে অভ্যস্ত। জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরাও বাংলাদেশি কর্মীদের প্রতি বেশ সদয়।
বাংলাদেশিরা বরাবরই জাপানিদের কাছে মাজিমে অর্থাৎ দায়িত্বসীল ও আন্তরিক কর্মী হিসেবে পরিচিত। এখন বাংলাদেশ সরকার যদি জাপান সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে জাপান ফেরত এসব দক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিকদের পাঠানোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে প্রথম দিন থেকেই জাপান গিয়ে তারা কাজ করতে পারবেন।
যেখানে একজন প্রশিক্ষণার্থী কর্মীর বেতন হবে মাত্র এক থেকে দেড় লাখ টাকা, সেখানে দক্ষ শ্রমিকরা প্রথম দিন থেকেই বেতন পাবেন কমপক্ষে আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা। আর এটা জাপান সরকারের সঙ্গে একটা সমোঝোতা স্বারকের মাধ্যমে করা এই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই সবচেয়ে বেশি সম্ভব।
জাপান শ্রম রপ্তানির উন্মুক্ত বিশাল বাজার। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ১৬টি ক্যাটাগরিতে (সাধারণ শ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক, কৃষিকাজ ও কেয়ার গিভারসহ) দেশটিতে শ্রম রপ্তানির বিশাল সুযোগ রয়েছে।
অবারিত সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ থেকে খুবই স্বল্প সংখ্যক শ্রমিক জাপান যেতে সক্ষম হন। বাংলাদেশ পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রমিক পাঠাতে ব্যর্থ হলেও প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, চীন ও ভিয়েতনাম থেকে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক শ্রমিক দেশটিতে যাচ্ছেন এবং তাদের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।
জাপানি ভাষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ যদি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আরও উদারনীতি গ্রহণ করে, তবে পারস্পরিক উন্নয়ন ও সহযোগিতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
জাপান ফেরত বাংলাদেশি কর্মীদের সংগঠন জেবিএফজি (জাপান-বাংলাদেশ ফেন্ডশিপ গ্রুপের মহাসচিব আপেল মাহমুদ বলেন, আমি দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জাপান ছিলাম। প্রথম চার বছর নিয়মিত ক্লাশ করেছি এবং পাশাপাশি ক্ণ্ডকালীন চাকরিও করতাম; কিন্তু কাজ করে যে টাকা উপার্জন করতাম, বছর শেষে টিউশন ফি বাবদ তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই জমা দিতে হতো।
এজন্য একপর্যায়ে ক্লাশ বন্ধ করে পূর্ণকালীন (ফুল টাইম) কাজে যোগ দিলাম। ফলে আমার ভিসার মেয়াদ আর বাড়লো না। এ সময় জাপানের অভিবাসন পুলিশের হাতে আটক হয়ে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে।
তাই সরকারের কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ ভাষা শিখিয়ে নতুনদের পাঠানো পাশাপাশি আমাদের মতো দক্ষ শ্রমিক যারা শুধু ভিসা জটিলতায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি, আমাদের পাঠানোর ব্যাপারে জাপান সরকারের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করুন। কারণ, জাপানে কর্মীদের বয়স বিবেচনা খুব একটা করে না, তারা কাজের দক্ষতা বিচার করে কর্মী নিয়োগ করে থাকে।
সম্প্রতি জাপানে দেশটির সরকারের ভিসা সংক্রান্ত বিষয়ে বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে কড়া নীতির প্রতিবাদে টোকিও ইমিগ্রেশনের সামনে দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকরা প্রতিবাদ সভা করেছেন।
প্রতিবাদকারীরা বিদেশি নাগরিকদের ভিসার নিয়ম সহজতর করা, বিদেশিদের প্রতি ইজিমে তথা বিদ্রূপ বা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য না করা, পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্মানের মর্যাদার সম্পর্ক বিনির্মানের দাবি তোলেন তারা।
উল্লেখ্য, জাপানে বিদেশি উদ্যোক্তাদের ভিসা পাওয়ার নিয়ম আরও কঠোর হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিদেশি উদ্যোক্তাদের আর সহজে ভিসা পাওয়া সম্ভব হবে না। কারণ নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী বিনিয়োগের ন্যূনতম অঙ্ক বাড়ানো হচ্ছে ছয় গুণ।
এখন থেকে ভিসা পেতে হলে উদ্যোক্তাদের কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ২ লাখ ৪ হাজার মার্কিন ডলার) বিনিয়োগ করতে হবে এবং জাপানে অন্তত একজনকে পূর্ণকালীন চাকরি দিতে হবে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উচ্চ কক্ষের নির্বাচনে অভিবাসন-বিরোধী একটি দল অপ্রত্যাশিত সমর্থন লাভ করে, যার ফলে ক্ষমতাসীন জোট সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরই বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য ভিসার শর্ত কঠোর করার পদক্ষেপ নিয়েছে জাপান।
দেশটির আইন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই পরিবর্তনগুলো আগামী অক্টোবরে কার্যকর করা হবে। তবে তার আগে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনগণের মতামত নেওয়া হবে। বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা ও ব্যবস্থাপনা ভিসা চালু হয়েছিল মূলত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বাড়াতে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে।
এর আগে এই ভিসার জন্য ন্যূনতম শর্ত ছিল ৫ মিলিয়ন ইয়েন বিনিয়োগ অথবা দুজন পূর্ণকালীন কর্মী নিয়োগের পাশাপাশি একটি কার্যকর ব্যবসায়িক পরিকল্পনা জমা দেওয়া। এই ভিসাধারীরা সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত জাপানে থাকতে পারতেন, পরে তা নবায়নের সুযোগও ছিল। পরিবারকেও সঙ্গে নেওয়া যেত এবং ১০ বছর পর স্থায়ী বসবাসের আবেদন করা যেত।
অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষনাগাদ প্রায় ৪১ হাজার ৬০০ জন এই ভিসার অধিকারী ছিলেন। সংখ্যাটি আগের বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভিসাধারী ছিলেন চীনা নাগরিক।
জাপান-ফেরৎ বাংলাদেশিরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছেন, জাপান সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে এ ব্যাপারে নতুন কোরও সমোঝোতা স্বারকে স্বাক্ষর করে হলেও দক্ষ এসব বাংলাদেশি কর্মীদের জাপান পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হোক।
এমএম সালাহউদ্দিন
লেখক: সংবাদকর্মী ও জাপান প্রবাসী